কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি: বয়স ৮১ বছর, সিরাজুল ইসলাম এসেছিলেন সাগরদাঁড়িতে বনভোজনে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন, শরীরটা ক্লান্ত হয়ে আসলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছেন। আবার ঘুরে দেখা শুরু। গোলাম সরোয়ারের যেন দেখার শেষ হচ্ছে না। মধুপল্লীর অলি-গলি ঘুরছেন। মাঝে এক ফাঁকে কিছুটা বিশ্রাম নিলেন। তাদের মতো ষাটোর্ধ্ব ৫০ জন এসেছেন সাগরদাঁড়ির জমিদার বাড়িতে।
ব্যতিক্রমি এই বনভোজনের আয়োজন করেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার চাপালী যুব সংঘ। সংগঠনটি তাদের গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলোকে নিয়ে আয়োজন করেন এই বনভোজনের। হলুদ গেঞ্জি আর ব্লু টুপি মাথায় দিয়ে সকলে ঘুরেছেন গোটা সাগরদাঁড়ি।
বুধবার সকালে বয়োজ্যেষ্ঠরা মধুপল্লীতে পৌছালে প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা ফুল দিয়ে তাদেন বরণ করেন। এ সময় তাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। উপস্থিত ছিলেন কেশবপুর বন্ধুসভার সভাপতি দীপ্ত রায় চৌধুরী, সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামান ও শরিফুল ইসলাম।
সিরাজুল ইসলাম জানান, তরুণ বয়সে ১৯৭১ সালে তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চাপালী যুব সংঘ। অর্ধশত বছর পেরিয়ে সংগঠনটির বয়স এখন ৫১ বছর। এই দীর্ঘ সময় পর আবার একত্রিত হতে পেরেছি, একসঙ্গে বনভোজনে আসতে পেরে খুবই খুশি জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের মানুষগুলো গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করে। শহরতলি ছেড়ে অনেকে চলে যান গ্রামাঞ্চলে। সেই সময়ে তারা তরুনরা গ্রামটিকে রক্ষা করতে গ্রামের মানুষদের বাঁচাতে একত্রিত হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই সংগঠনটি।
সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠার সময় খড়ের চাল, আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করেন। গ্রামের প্রভাবশালী সুধীন্দ্রনাথ ওরফে মানু ঘোষের বাড়িতেই অবশ্য শুরু হয়েছিল প্রথম কার্যক্রম। সেখানেই মঞ্চস্থ হয় চাপালী যুব সংঘের নাটক ‘তেরশো পঞ্চাশ’। সেই সময়ে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ জন, যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১২১ জন। এই ক্লাবের হাত ধরেই আর ক্লাবের সদস্যদের প্রচেষ্টায় পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে চাপালী ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, চাপালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাপালী ঈদগাহ, চাপালী মসজিদ, চাপালী ফুটবল মাঠ ও চাপালী পাবলিক লাইব্রেরি।
ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম জানান, তারা এই ক্লাবের উদ্যোগ ৩২ হাজার মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছেন। এ পর্যন্ত ২৮ টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রতিবছর ফুটবল টুর্নামেন্ট, ধর্মিয় সভা, জাতীয় সকল দিবস উদযাপন, ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন, সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন তারা। আগামীতে তাদের গ্রামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যে সরকারের দপ্তরে আবেদন জমা দিয়েছেন বলে জানান।
বয়োজ্যেষ্ঠদের বনভোজন সম্পর্কে ক্লাবের সভাপতি আজাদ রহমান জানান, ক্লাব থেকে তারা প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরতে যান। এবারও তারা পদ্মা সেতু দেখতে গিয়েছিলেন চলতি মাসের ১২ তারিখ। সেখান থেকে ফেরার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয় বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য এই বিনোদন দেয়া যায় কিভাবে। যারা এখন আর ঘুরতে যেতে পারেন না, তাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে কেউ চান না। শেষে সিদ্ধান্ত হয় ষাটোর্দ্ধদের নিয়ে বনভোজন করা। সেই সিদ্ধান্ত থেকে বুধবার তারা এসেছেন যশোরের সাগরদাঁড়ি।
এই বনভোজন করতে আসা এবং ক্লাব প্রতিষ্ঠাকালের সদস্য শাহজাহান জানান, এই আয়োজনটি একটি ব্যতিক্রমি আয়োজন। তারা ভাবেননি বৃদ্ধ সব মানুষগুলোর জন্য এমন আয়োজন হতে পারে। এই আয়োজনে তারা সাড়া দিয়েছেন, মনের আনন্দে এসেছেন।
মধুপল্লীর কাস্টডিয়ান আইরিন পারভীন জানান, অনেকে এই মধুপল্লীতে আসেন। তবে এমন বয়োজ্যেষ্ঠদের আসতে দেখে তিনি খুবই খুশি। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, এমন আয়োজন খুবই ব্যতিক্রম। বয়স্ক মানুষগুলো এতো কষ্ট সহ্য করে এই দূরের রাস্তায় বনভোজনে এসেছেন, এটা ভাবা যায় না। তাদের এই ঘুরতে আসা দেশকে জানা অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।