জাহিদ হাসান
দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ঠিক এ মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন হলেও যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনে এমপিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ তুঙ্গে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে এ বিরোধ বলে নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ ও একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বর্তমান এমপিরা। এমন পরিস্থিতিতে তারা নানা উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধন করে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। একই সাথে দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে লবিং তদবিরও জোরদার করেছেন।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত যশোর-১ (শার্শা) আসনটি ২০০১ সালে হাতছাড়া হলেও পরবর্তীতে শেখ আফিল উদ্দিনের হাত ধরে সেটি পুনরায় উদ্ধার হয়। টানা তিনবারের এমপি আফিল উদ্দিনের আসনে ‘গৃহবিবাদও’ আছে। এরই সূত্র ধরে এবার তার একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে নেমেছেন। আফিলের দুর্গ ভাঙতে চান তারই একসময়ের রাজনৈতিক সহচর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন। বলা যায়, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য বজা রাখা আফিলের দুর্গে তিনি ভাগ বসিয়েছেন। গেল দুটি ইউপি নির্বাচনে ৪-৫জন তার বলয় থেকে মনোনয়ন পান। কোন কোন ইউনিয়নের আ.লীগের শীর্ষ নেতা তার সাথে রয়েছেন। শার্শা আওয়ামী লীগে মোটামুটি একটি বলায় তৈরি করেছেন লিটন। আগামি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন যুদ্ধে এমপি আফিলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী লিটন। এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে নতুন বলয়ের সৃষ্টি করছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নাজমুল হাসান ও জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মুজিবুদ্দৌলা সরদার কনকও। এই বিষয়ে বর্তমান এমপি আফিল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তার অনুসারী বেনাপোল পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র নাসির উদ্দিন বলেন, এখানে কোন গ্রুপিং নেই। দল অনেকদিন ক্ষমতায়; সবাই জনপ্রতিনিধি হতে চায়। কিন্তু নেত্রী জানে কাকে মনোনয়ন দিলে দল সুসংগঠিত থাকবে।
ঝিকরগাছা-চৌগাছা উপজেলা নিয়ে যশোর-২ আসন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন। এই আসনের দুটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্যের দূরত্ব রয়েছে। দুই উপজেলার সভাপতি-সম্পাদকের অভিযোগ বর্তমান এমপি স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করাতে উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. নাসিরের দাবি, পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে নৌকার পক্ষে সবাই এক।
বর্তমান এমপিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভক্তি। এমনকি এই আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিরোধে মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে মনোনয়নকে ঘিরে। এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ না নিলে আগামী নির্বাচনে চরম খেসারত দিতে হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। বর্তমান এমপি নাসিরকে এবার দলীয় মনোনয়ন পেতে শক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ার হোসেন, সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের জামাতা ও বিশিষ্ট হৃদরোগ চিকিৎসক তৌহিদুজ্জামান তৌহিদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসানুল হক আহসানকে।
যশোরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন যশোর-৩ (সদর)। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। এই আসনে দলীয় কোন্দল প্রকট। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিল আহমেদের মধ্যে শুরু হওয়া কোন্দল আরও প্রকট হয়েছে। যদিও দুই নেতা কোন্দলের বিষয়টি মানতে নারাজ। এছাড়া বর্তমান এমপি কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভক্তি রয়েছে। এমপির সঙ্গে কোন সভা সমাবেশে উপস্থিত থাকেন না; উপজেলার সভাপতি মোহিত কুমার নাথ ও সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। এই দুই নেতার অভিযোগ জামাত-বিএনপি অনুপ্রবেশকারীদের মূল্যায়ন করাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের একটি পক্ষকে নিয়ে তিনি উপজেলার রাজনীতি করেন বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। নাবিলের এবার দলীয় মনোনয়ন পেতে শাহীন চাকলাদার ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা রওশন জাহান সাথী ও সাবেক মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টুর সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এই বিষয়ে কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তার অনুসারী জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, সভানেত্রী মনোনয়ন দিবে। দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কার পক্ষে আছে কি না সেটা বড় বিষয় না। দল যাকেই নৌকা দিবে তৃণমূল তার পক্ষে কাজ করবে। নাবিল আহমেদের সঙ্গে তৃণমূলের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনে কোন প্রভাব পড়বে না।
অভয়নগর-বাঘারপাড়া উপজেলা এবং সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন যশোর-৪। মাঠপর্যায়ে যে ভোটের আমেজ ব্যানার, ফেস্টুন, সমাবেশ, গণসংযোগে তা প্রকাশ পাচ্ছে। আর রাজনীতির মাঠ এরই মধ্যে গরম। একই দলের একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাশার তৎপরতায়। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য রনজিৎ রায়। টানা তিনবারের এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে দুই উপজেলার নেতাকর্মীদের দূরত্ব চরমে। নীরব এক স্নায়ুযুদ্ধ চলছে এমপি বনাম উপজেলা আওয়ামী লীগে। দুই উপজেলায় নেতারা নানা দল, উপদলে বিভক্ত। দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দিয়েই চলছে বাঘারপাড়া কমিটি। সভাপতি রণজিৎ রায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে যান না সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী। অন্য নেতারাও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন পৃথকভাবে। নেতাকর্মীদের ভাষ্য, এমপির সঙ্গে নানা কারণে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় আগামী নির্বাচনে দলের অন্তত নয়জন নেতা প্রার্থী হতে আগ্রহী। ফলে নৌকার মনোনয়ন পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে আওয়ামী লীগ নেতা ও যশোর মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার, সাবেক অতিরিক্ত সচিব বীরমুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ অধিকারী, অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক বাবুল, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল কবির বিপুল ফারাজী ও আওয়ামী লীগ নেতা আরশাদ পারভেজের সঙ্গে। এই বিষয়ে এমপি রজনজিৎ রায় বলেন, এ বিভাজন শুধু নেতাদের মধ্যে, যারা পদ চান। কেউ সভাপতি, সম্পাদক হতে চান; কেউ এমপি-চেয়ারম্যান হতে চান তারাই এই বিভাজন সৃষ্টি করছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। তিনি আরও বলেন, মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করবেন। নৌকার বাইরে কেউ গেলে কর্মীরাই তাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা মণিরামপুরের ১৭ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা নিয়ে যশোর-৫ সংসদীয় আসন। আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরেই এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরাই নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তবে এখন দলীয় কোন্দল এই আসনের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ এখানে প্রার্থী বদল চান। বর্তমান সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। ২০১৪ সালে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে এমপি নির্বাচিত হন। পরের বার (২০১৮) দলের টিকিটে এমপি হয়ে প্রতিমন্ত্রী হন। এরপর থেকে তার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের একটি বলায় সৃষ্টি হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহামুদুল হাসান প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে রাজনীতি করলেও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদকসহ বড় একটি পক্ষ প্রতিমন্ত্রীর বিপক্ষে। ভবদহ অঞ্চল নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে হলে এবং নির্বাচনে জয় পেতে হলে এবারের নির্বাচনে নতুন প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন বলে একাংশের নেতারা মনে করছেন। স্বপন ভট্টচার্য্যকে এবার নিজ দলের মনোনয়ন নিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল মজিদ, উপজেলা চেয়ারম্যান নাজমা খানম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলীর সঙ্গে। স্বপন ভট্টচার্য্য বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আগেও ছিলো; ভবিষ্যতে থাকবে। কারোও কারেও কাছে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে নির্বাচন আর দলের কাছে সবাই এক।
যশোরের দক্ষিণ প্রান্তের উপজেলা কেশবপুর। এখানে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোট রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের ভোটসংখ্যাও কম নয়। নির্বাচনে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে আওয়ামী লীগকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে। এই আসনের বর্তমান এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। কেশবপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি এস এম রুহুল আমিন, কেশবপুর পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামসহ দলের বড় একটি অংশ তার সাথে আছে। যদিও কেশবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলাম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফাসহ একটি অংশ শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে নেই। এমপি বিরোধী নেতাকর্মীদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে কেশবপুরে স্থানীয় বাসিন্দা নৌকার মনোনয়ন পাচ্ছেন না। তাই স্থানীয় কোন আওয়ামী লীগের নেতাকে তারা দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। শাহীন চাকলাদারকে দলীয় মনোনয়ন নিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলাম, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এইচ এম আমির হোসেনের সঙ্গে।
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এমপি বলেন, ‘দলের ভিতর গ্রুপিং দ্বন্দ্ব নেই। সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ। বড় দল আওয়ামী লীগ; তাই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দিবে; সবাই বিভেদ ভুলে নৌকার পক্ষে কাজ করবেন। আমরা সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। আগামি নির্বাচনে যশোরের ৬টি আসন বিজয়ী করে আবারও শেখ হাসিনাকে উপহার দিবো।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, আমাদের ৮ উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে নিজেদের ভিতরে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু নেতাকর্মীরা নৌকার প্রশ্নে সবাই এক। কারণ এবার আমাদের ক্ষমতায় যেতেই হবে। কারণ এতোদিন যে উন্নয়ন করেছি; সেটা একেবারেই থমকে যাবে।