নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত যশোর-৩ (সদর)। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। এই আসনে বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েট প্রার্থী হলেন আওয়ামী লীগের টানা দুইবারের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ ও বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। মাস দেড়েক আগেও উপজেলাতে সভা সমাবেশের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন এই দুই প্রার্থী। বর্তমানে নাবিল তার সেই কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেও নির্বাচনি প্রচারে নেই অমিত। নতুন পুরনো মিলে ৬৫ মামলা কাঁধে নিয়ে গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে এই প্রার্থী। শুধু যশোর সদর উপজেলাই নয়; যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনেই প্রার্থীদের নির্বাচনী চিত্র একই। নেতাকর্মীরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই উজ্জীবিত যশোর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জেলার উপজেলা শহর-বাজার, পাড়া-মহল্লায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এর ঠিক বিপরীত চিত্র বিএনপিতে। দলটির জেলা-উপজেলার শীর্ষ থেকে থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এখন ঘরছাড়া। গ্রেপ্তার হয়ে যশোর কারাগারে ৬ শতাধিক নেতাকর্মী। হামলা-মামলার ভয়ে আত্মগোপনে আছেন অধিকাংশ প্রার্থী। তারা বলছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবল তারা ভোট করবেন। এদিকে, নির্বাচন সামনে রেখে যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপত্র নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র নিয়েছেন অন্তত ৬৫ জন। ইতোমধ্যে অধিকাংশ মনোনয়নপ্রত্যাশী তাদের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা এখন দলের নীতিনির্ধারণীদের কাছে তদবিরে ব্যস্ত।
বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের দু’দিন আগে থেকে যশোরের পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়। গত ২৩ দিনে জেলা ও উপজেলা বিএনপির সহযোগী সংগঠনের শীর্ষনেতাসহ প্রায় ৬শ’ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। মামলা হয়েছে ২৬টি। পুলিশের করা এসব নাশকতা মামলায় গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে রয়েছে জেলা ও উপজেলার শীর্ষ নেতাসহ দ্বাদশ নির্বাচনে আগ্রহী বেশির ভাগই ধানের শীর্ষের প্রার্থী আত্মগোপনে। ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন তিন জন। অভিযান চলছে প্রতি রাতেই। দলটির থানা ও ওয়ার্ড কমিটির নেতারাও এখন বাড়িতে থাকতে পারছেন না। দলটির কার্যালয় বন্ধ রয়েছে মাস খানিক ধরে।
বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। এই সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এজন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছি। যদি নির্দলীয় কোনো সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়, তখন নির্বাচনে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে। তবে নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর- ১ (শার্শা) আসনে বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মফিকুল ইসলাম তৃপ্তি, শার্শা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুজ্জামান মধু ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান জহির নির্বাচনে প্রচারণা চালালেও গত মাস থেকে ধরপাকর শুরু হলে তারা তিন জনই আত্মগোপনে রয়েছেন। এমনকি চলমান আন্দোলনেও তাদের মাঠে দেখা যায়নি বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অ্যাড. ইছাহক আলী, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ও ঝিকরগাছা বিএনপির আহ্বায়ক মোর্তজা এলাহী টিপু গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে। আর বিএনপি কেন্দ্রীয় সদস্য সাবিরা নাজমুল মুন্নী ও চৌগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম নাশকতা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। যশোর-৩ (সদর) আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত একক প্রার্থী। তার বিরুদ্ধে নতুন করে ৪টি মামলা হয়েছে। চলমান হরতাল অবরোধের প্রথম তিন দিন মাঠে থাকলেও ৬৫টি মামলার গ্রেফতার আতংকে তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে। যশোর-৪ (বাঘারপাড়া -অভয়নগর) আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য টি এস আইয়ুব, ফারাজী মতিয়ার রহমান ও বাঘারপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল হাই মনা আত্মগোপনে রয়েছেন। যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে মণিরামপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মুছা, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি গ্রেফতার আতংকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে জেলা বিএনপির সদস্য আবুল হোসেন আজাদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অমলেন্দু দাস অপু, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, উপজেলা বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম বিশ্বাস ধরপাকড় শুরুর পর থেকে তারা আত্মগোপনে। যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, বিএনপি কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতারা জেলে; কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা কোনো নির্বাচনের পরিবেশ হলো ? দলটির থানা ও ওয়ার্ড কমিটির নেতারাও এখন বাড়িতে থাকতে পারছেন না।
অন্যদিকে, যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনেই রয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি। কিন্তু ছয় এমপির সঙ্গেই তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিরোধ রয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে এ কোন্দল আরও বেড়েছে। ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ৬৫ জন। ইতোমধ্যে অধিকাংশ মনোনয়নপ্রত্যাশী তাদের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। জেলার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীরা এখন সবাই রাজধানী ঢাকাতে। মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তদবিরে ব্যস্ত বলে জানাগেছে।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে নেতাকর্মীরা নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছে। নির্বাচন সফল এবং বিএনপির আন্দোলন প্রতিহত করতে কর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতাকর্মীরা এখন উজ্জীবিত এবং সক্রিয়। প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী সক্রিয়। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, সবাই তার পক্ষে কাজ করার বিষয়ে একমত। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘বিএনপির কোন নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বা গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে; শুধু মাত্র তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।