মাদক দমনে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে জেলা পুলিশ। কেউ পার পাবে না : জুয়েল ইমরান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ক-সার্কেল
লাবুয়াল হক রিপন
রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় মাদকে ভাসছে যশোর। প্রশাসন যখন কঠোর হয় তখনই তারা নেতাদের কাছে ধর্না দেন। মিছিল মিটিংয়ে যোগ দেন। টাকা বাড়িয়ে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসৎ কর্মকর্তাদের। অবলম্বন করেন নতুন নতুন কৌশল। ব্যবসার ধরণ পাল্টে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে শিশু-কিশোর ও নারীদের। মাদক পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রেও ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, রিক্সা এমনকি বাইসাইকেলও ব্যবহার করা হয়।
বদলে গেছে বিক্রির ধরণ :
স্পটে ছাড়াও অফিস এবং বাসা-বাড়িতে নিমিশেই ক্রেতাদের হাতে পৌছে দেয়া হচ্ছে মরণ নেশা ইয়াবা, ফেনসিডিল; এমনকি আইসসহ নানা ধরণের মরণ নেশা। ফেসবুক, মেসেঞ্জার এবং হোয়াট্সঅ্যাপেও অর্ডার নেয়া হয়ে থাকে।
মাফিয়া স্টাইলে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ:
বর্তমানে দাগি সন্ত্রাসীরাই মাদকের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর নিষিদ্ধ এই ব্যবসার উপর সামাজিক চাপ ঠেকাতে মাফিয়া স্টাইলে আগ্নেয়াস্ত্র ও ব্যবহার করা হয়। মাদকাসক্ত ও দাগি সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালানো হয়ে থাকে।
বহন-বিক্রিতে শিশু-কিশোর ও নারী :
মাদক বহন ও বিক্রিতে শিশু-কিশোর ও নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যশোর শহরের ষষ্ঠীতলা বুনোপাড়ার চিহ্নিত কারবারি হাফিজুর রহমান মরার পরিবার এখন ওই এলাকার শীর্ষে। তার মৃত্যুর পরে স্ত্রী রেখা বেগম পুরোদমে কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ইয়াবাকে ‘বাবা’ নামে পরিচিতি নিয়ে রেখা কারবারী ও সেবীদের কাছে পৌছে দিয়ে থাকেন। একই বাড়িতে সাইফুল ইসলামের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী হাসিনাও কম নয়। স্বামীর মৃত্যুর পরে রায়হান নামে এক যুবককে বিয়ে করে এনএন বেগমের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস ও মাদকের কারবার করছেন। সাইফুলের ভাই রবিউল ইসলাম এখন ফেনসিডিল তৈরি করতে সক্ষম। কিছুদিন আগে রবিউলের ফেনসিডিল তৈরির কারখানা বিরুদ্ধে দৈনিক কল্যাণ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে তা নিরব রয়েছে।
রেলগেট পশ্চিমপাড়ায় রয়েছে কয়েকজন শীর্ষ কারবারী :
ওই এলাকার সাগর-রমজান, ডালিম ও রানা পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজন অধিকাংশই এই পেশায় রয়েছে। রানার মা ফাতেমা, ভগ্নিপতি টালি বাবু নিয়মিতই কারবার করছেন। ডালিম ওরফে নদী দীর্ঘদিন ধরে এই কারবার করছেন। তার মা রিজিয়া, মেয়ে মিতু, ছেলে আলামিন এবং ভাই লুতু রয়েছে তার সহযোগি। মেয়ের স্বামী মানিক কয়েক বছর আগে ক্রসফায়ারে নিহত হন। পরে কক্সবাজারের এক শীর্ষ কারবারিকে বিয়ে করেছেন। আর সেখান থেকে প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ পিস ইয়াবা যশোরে আসে। এছাড়া সাগর-রমজান শুধু মাদকই নয় বরং অস্ত্রের কারবারও তাদের পুরোনো। তাদের মা রেখা এবং বাবা ফায়েক এই সকল অবৈধ ব্যবসার মূল কারবারী। বর্তমানে রেখা মাদক বিকিকিনিতে বোমা হাতে নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন।
চাঁচড়া রায়পাড়া আবারও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে :
এলাকার কয়লাপট্টির রশিদ, প্রিন্স ও তার মা জোহরার রয়েছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। এলাকার নাসরিন, শেফালীসহ বেশ কয়েকজনেই ওই কারবারে রয়েছেন।
বারান্দীপাড়ায় ‘নিত্য মাদকের হাট’ :
সন্ধ্যা হলেই ওই হাটে বিকিকিনি শুরু হয়। দূরদুরান্ত থেকে আসা ক্রেতা বা সেবীরা সেখানে নিয়মিতই ভিড় জমান। শীর্ষ কারবারি আবু তালেবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে তার সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন ভাতিজা জাকির হোসেন টুটুল। তবে একই এলাকায় জাকির নামে আরেকজনও এই ব্যবসার সাথে জড়িত বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে।
রায়পাড়া কয়লাপট্টিতে আরেকটি সিন্ডিকেট :
রায়পাড়ার সেকেন্দার মরা ওরফে হোসেন মরা নামে একজন নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সের পরিচয় দিয়ে থাকেন। ওই পরিবারেও রয়েছে কয়েকজন কারবারী। মরার মা সাহিদা সাই, স্ত্রী আসমা এবং আসমার মা নাহার পুরোদমেই কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে হোসেন মরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আটক করা মাদক বিক্রি করে। এলাকায় এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার রয়েছে।
মুরগি রহিম নামে রয়েছেন একজন শীর্ষ কারবারী। ফেনসিডিল তৈরিতে অভ্যস্ত এবং নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সের পরিচয় দিয়ে অন্য কারবারীদের কাছ থেকে হিস্যা আদায় করে থাকেন। এছাড়া মুরগি রহিমের স্ত্রী দুলারী, মেয়ে সুরাইয়া, সুরাইয়ার স্বামী রনি, রনির মা রওশনারা একই কারবারে অভ্যস্ত।
এলাকার ডলারের স্ত্রী ভানু, ভানুর বোন মঙ্গলীও কারবার করেন।
যশোর জেলায় শীর্ষে যাদের নাম :
ইসমাইল কলোনীর ময়না, দোয়েল টিয়া, কয়লাপট্টির সজল, সবুজ, ষষ্ঠীতলার পিয়া, শংকরপুরের শীর্ষ মাদক কারবারী তারেক সৌদি আরব থাকেন বলে প্রচার করেন। তার স্ত্রী টিয়া মন্ডলগাতি এলাকায় বসবাস করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের দিকে তৎকালীন এসপি আনিসুর রহমান তালিকাভুক্ত ১৪ মাদক ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেন। তারা হলেন-চাঁচড়া রায়পাড়ার বেবি খাতুন, তার দুই ছেলে জনি ও পনি, রুমা বেগম, চৌগাছার কাবিলপুরের শফি মেম্বার, অভয়নগরের বুইকরা এলাকার কামরুল ও লিপি, বেনাপোল ভবেরবেড় এলাকার রবিউল ইসলাম, বারপোতার রিয়াজুল ইসলাম, চৌগাছা ফুলসারা এলাকার আশরাফুল, কাবিলপুর এলাকার ইসরাইল হোসেন নুনু, শার্শার আনোয়ার হোসেন আনা, বাদশা মল্লিক ও জাহাঙ্গীর। সে সময় এসব মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেন তৎকালীন এসপি। কিন্তু অনেকে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের সেল্টারে আছে বলে প্রচার করেন। ফলে অনেককে আটকের ক্ষেত্রেও হিমসিম খেতে হয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
সার্বিক বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক-সার্কেল জুয়েল ইমরান জানিয়েছেন, মাদক দমনে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে জেলা পুলিশ। যারাই মাদকের কারবার করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।