কল্যাণ ডেস্ক
সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুগঠিত মস্তিষ্ক নিয়ে শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে গর্ভবতীর যত্ন ও পুষ্টির বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে নানা সমস্যা নিয়ে শিশু জন্ম নেয়।
অথচ শিশুর জন্মের কয়েক সপ্তাহ আগে মায়ের দেহে ডকোসাহেক্সাইনয়িক অ্যাসিড-ডিএইচএ এবং অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড-এআরএ এ দুই উপাদান আছে এমন খাদ্য নিশ্চিত করা গেলে, তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানালেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানী অসীম কান্তি দত্ত রায়।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে গর্ভবতীদের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই গবেষক বলেন, সামুদ্রিক মাছ, ইলিশ মাছ, কলাইয়ের ডাল ও বিভিন্ন ধরনের শাকে এ দুই পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
এ ছাড়া শর্ষের তেলে আলফা লিনোলিক অ্যাসিড আছে, যা মায়েরা খাওয়ার পর মেটাবোলাইজড করে ডিএইচএ তৈরি করে। এসব খাবার সুস্থ ব্রেইন নিয়ে শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অসীম কান্তি দত্ত রায় নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে মনোনয়নের জন্য গঠিত নোবেল কমিটির অন্যতম সদস্য। তিনি বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চের প্রধান সম্পাদকও।
গর্ভাবস্থায় মায়ের গর্ভফুলে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড জমা হয়ে তা জরায়ুতে ভ্রূণে কীভাবে সঞ্চার করে এবং এর ফলে শিশুর ব্রেইন কীভাবে সুগঠিত হয়, তা নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে তার নিরলস গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অসীম কান্তি দত্ত রায় বলেন, আমার গবেষণার বিষয়ই এ দুই উপাদান কীভাবে রক্তরস থেকে গর্ভফুলের মাধ্যমে ভ্রূণে যায় এবং ব্রেইন সুগঠিত করে।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ব্যায়াম নয়
তিনি বলেন, ভ্রুণের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের গর্ভবতীদের পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টি না নিশ্চিত হলে ভ্রূণ মানব শিশুর দেহে পরিণত হতে পারে না। যখন লিভার, ব্রেইন এগুলো সুগঠিত করতে গিয়ে মাংসপেশি ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, তখন ভ্রূণের বিকাশে সমস্যা হয়। ফলে মায়ের গর্ভ থেকে অপুষ্টি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকি থাকে।
মানব শিশু জন্মের আগেই মস্তিষ্ক সুগঠিত হওয়ার বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, মায়ের গর্ভে থাকা কালে শেষের কয়েক সপ্তাহে মানব শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয়। আর তা নির্ভর করে ডিএইচএ ও এআরএ পুষ্টি উপাদানের ওপর।
এ দুটো উপাদান রক্তরসে (প্লাজমা) জমা হয়, এরপর গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) দিয়ে ভ্রূণে যায়। গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এ পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত করা না গেলে জন্মের পর সেই শিশুর একটি সংকটপূর্ণ জীবন (কম্প্রোমাইজড লাইফ) হয়। সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা, মনোযোগ কম, আচরণে অসঙ্গতি, শ্লথগতি, আইকিউ লেভেল হাইলি কম্প্রোমাইজডসহ নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা নিয়ে এ শিশুরা বেড়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, গর্ভবতী মায়েদের ওপর বিভিন্ন গবেষণায় প্রিম্যাচিউরড অবস্থায় জন্ম নেওয়া শিশুদের এ ধরনের সমস্যাগুলো বেশি দেখা গেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা বিদ্যায় উন্নতি ও সচেতনতার কারণে এসব সমস্যা নিয়ে শিশুরা বেশিদিন বাঁচতে পারছে। তবে তাদের এ বেঁচে থাকাটা খুবই ব্যয়বহুল।
অসীম বলেন, ভ্রূণ অবস্থায় ব্রেইনের কাঠামোগত উপাদান ডিএইচএ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্যান্য প্রাণীর জন্মের পর মস্তিষ্কের বিকাশ হয়; কিন্তু মানুষের জন্মের আগেই ওই দুই পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত হতে হবে। সেটাই মস্তিষ্ক বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে প্রচুর সামুদ্রিক খাদ্য না থাকলেও তিনি গর্ভবতী ও প্রসূতিদের অর্গানিক খাবার ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আছে এমন খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।
ডিএইচএ ও এআরএ—এ দুই পুষ্টি উপাদান নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণা নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, ভারতের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানকার শিশুরা এই দুই উপাদান কম পায়।
যেসব দেশে সামুদ্রিক মাছ বেশি খাওয়া হয়, সেখানকার শিশুরা কম ঝুঁকিতে থাকে। এসব উপাদান মায়ের দেহে কম গেলে শিশু শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
মাছে-ভাতে বাঙালির বাংলাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সমৃদ্ধ বিকল্প খাবার কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক অসীম বলেন, মিঠা পানির মাঠে ওমেগা থ্রি নেই। বাংলাদেশে চট্টগ্রামে সামুদ্রিক মাছ আছে, সেখানকার মানুষ এ পুষ্টি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে তাই সি ফুড বলতে ইলিশই আছে। যদিও দরিদ্র মানুষ দামের কারণে ইলিশ খেতে পায় কম। তবে বাঙালিদের সৌভাগ্য কলাইয়ের ডাল ও বিভিন্ন ধরনের শাকেও এ উপাদান আছে। মাছের যকৃত থেকে আহরণ করা কড লিভার অয়েলও একটি সম্পূরক উপাদান। এ ছাড়া শর্ষের তেলে আলফা লিনোলিক এসিড আছে, যা মায়েরা খাওয়ার পর মেটাবোলাইজড করে ডিএইচএ তৈরি করে।
একটি বিকল্প ওমেগা থ্রি উৎসের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি জানান, জাপান এলগার সোর্স থেকে বিকল্প পুষ্টি উপাদান তৈরি করছে। ইউরোপেও আছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যেখানে পর্যাপ্ত সি ফুড নেই, তাদের জন্য বার্তা একটাই, গর্ভবতীদের সুষম খাদ্যের পাশাপাশি এই দুটি পুষ্টি উপাদানও নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে জরিমানা ২০ হাজার টাকা
