নিজস্ব প্রতিবেদক
শনিবার মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে যশোরের পৌর এলাকা। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে পানি। কোন কোন সড়কে হাঁটু, কোন কোন সড়কে কোমর ছুয়ে যায় পানি। এসব সড়কে চলাচলরত রিকশা ও ইজিবাইকগুলোর অর্ধেক ডুবে যেতে দেখা যায়।
শহরবাসীর ভাষ্য, পানি নিষ্কাশনের খাল ভরাট, কালভার্ট বেদখল ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পৌরসভায় গাফিলতিতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং অপরিকল্পিতভাবে ড্রেন নির্মাণ করার খেসারত দিতে হচ্ছে পৌরবাসীকে। একটু বৃষ্টিতেই ড্রেন ও রাস্তার পানি একাকার হয়। আর ভারি বর্ষণে প্রায় সব সড়কের উপর জমে পানি।
আবহাওয়া অফিস মতে, মধ্য আষাঢ় পর্যন্ত যশোরে তেমন বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। গত এক সপ্তাহ ধরে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। কখনো হালকা, কখনো মাঝারি বৃষ্টিপাতের দেখা মিলছিল এই সময়ে। শনিবারও সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত থেমে থেমে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত জেলায় চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী কয়েকদিন ধরে এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস রয়েছে।
শনিবার সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশের বেশিরভাগ ড্রেন দিয়ে পানি নামছে না। কোন কোন এলাকার ড্রেন থেকে সড়কে উঠছে পানি। শহরের পাইপপট্টি, টিবি ক্লিনিক রোড, ষষ্ঠীতলাপাড়া, বেজপাড়া মেইন রোড, পিয়ারী মোহন রোড, বুনোপাড়া, বকচর হুশতলা সড়ক, পুরাতন কসবা ও ঘোপ ধানপট্টি এলাকাসহ বিভিন্ন সড়ক ও পাড়া মহল্লায় বৃষ্টির পানি জমে যায়। এতে বিপাকে পড়ে রিকশা চালকসহ শ্রমজীবী মানুষ। বৃষ্টিতে ভিজেই তাদেরকে কাজ করতে হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে।
যশোর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সংলগ্ন গুরুদাস বাবু লেনে হাঁটু পানির ঢেউ খেলতে দেখা যায়। বৃষ্টির পর এ রোডের পাইপপট্টি এলাকায় যেয়ে দেখা গেছে, রাস্তার দুধারের দোকানগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। দোকানের ভিতরেই এক হাটু পানি। দোকানিরা মগ, বালতি গিয়ে পানি নিস্কাশনের চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান বলেন, কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সড়কে হাঁটু পানি জমেছে। সড়কের পাশে ড্রেন থাকলেও আবর্জনায় পূর্ণ হওয়ায় পানি উপচে সড়কে প্রবেশ করেছে। সড়কের সেই পানি আবার দোকানে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, সড়ক নিচু আর ড্রেন হয়ে গেছে উঁচু। তাই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপায় না পেয়ে ব্যবসায়ীরা যে যার মতো পানি পরিস্কার করছেন।’
একই অবস্থা ছিল এমএম কলেজের দক্ষিণ গেটের সামনের রাস্তার। সেখানে রাস্তার উপর কোমর পর্যন্ত পানি জমে। রেল রোডের টিবি ক্লিনিক মোড়েও করুণ অবস্থা। সেখানে চলাচলরত ইজিবাইক অর্ধেক ডুবে যেতে দেখা যায়। শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার অধিকাংশ বাড়ির ঘরের মধ্যে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে আতংকিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। শংকরপুর এলাকার বাসিন্দা মতিয়ার আলী বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই আমাদের ঘরবাড়ি সব পানিতে তলিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আমাদের রান্না খাওয়া। বর্ষা মৌসুমে এমন পরিস্থিতিতেই আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
অপর একজন বাসিন্দা বলেন, যে কেউ আমাদের ঘরবাড়ির অবস্থা দেখলে মনে করবে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অথচ সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের এই হাল। যদি বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় আমাদের অবস্থা সিলেট, সুনামগঞ্জের থেকেও ভয়াবহ হবে।
শহরের বাসিন্দা আইয়ুব হোসেন বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়ক হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। ড্রেনগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় পানি নিষ্কাশন হতে পারছে না। শহরে পানি নিস্কাশন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় হালকা বৃষ্টিতেও তলিয়ে যায় শহরের অধিকাংশ এলাকা। এমন পরিস্থিতি পৌরকর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই ঘটছে বলে মন্তব্য করেন পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং দুর্নিতীর জালে আটকে গেছে যশোর শহরের উন্নয়ন। যার কারণে হালকা বৃষ্টি হলেও তলিয়ে যায় শহর। ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের।
যশোর পৌর কর্তৃপক্ষের মতে, মুক্তেশ্বরী নদীতে বাঁধ থাকায় ও হরিণার বিলে পলি জমে যাওয়ায় পৌর এলাকার পানি সরছে না।
যশোর পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের সময় গত ৭ বছরে শহরে ৪০ কিলোমিটার আরসিসি ড্রেন নির্মাণ হয়েছে। এখনো অনেক ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। সিআরডিপি, ইউজিপআইআই-৩ প্রকল্পের মাধ্যমে এসব নির্মাণ কাজ হয়েছে। জানতে চাইলে যশোর পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোকসিমুল বারী অপু বলেন, আগে শহরের পানি মুক্তেশ্বরী নদীতে পড়ত। সেই নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। এ কারণে পৌর এলাকার পানি মুক্তেশ্বরী নদীতে যাচ্ছে না। হরিণার বিলে পলি জমে সেখানেও পানি যাচ্ছে না। বিলটি খননের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ড্রেনে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে পানি সরছে না। অনেকে আবার পৌরসভার ড্রেনের সঙ্গে বাড়ির পানি ও ময়লার অপসারণের পাইপ সংযুক্ত করে রেখেছেন।