নিজস্ব প্রতিবেদক: সরিষা ফুলের হলুদ হাসিতে রঙিন হয়ে উঠেছে যশোরে দিগন্ত জোড়া মাঠ। যেদিকে চোখ মেলবে সেদিকেই দেখা মিলছে হলুদের চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ণ মাঠ। জেলার বিস্তীর্ণ মাঠগুলো যেন হলুদ বর্ণে ঘেরা স্বপ্নীল পৃথিবী। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল সোনাঝরা রোদে যেন ঝিকিমিকি করছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, নিকট-অতীত যেকোনো সময়ের অপেক্ষা চলতি মৌসুমে যশোরাঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ রবি ফসলের আবাদ হয়েছে। এসব ফসলের সিংহ ভাগই জুড়ে আছে সরিষা আবাদ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরাঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোরাঞ্চলের আওতাভূক্ত ৬ জেলা যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে।
এই ৬ জেলায় ৫৪ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সেখানে চাষ হয়েছে ৭২ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে যশোরে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সেটি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে চাষ ২৪ হাজার ৮৪৮ হেক্টর জমিতে।
এর বাইরে ঝিনাইদহে ৯ হাজার ৭৭৭ হেক্টরের বিপরীতে চাষ হয়েছে ১১ হাজার ১১২ হেক্টর, মাগুরায় ১৫ হাজার হেক্টরের বিপরীতে ১৬ হাজার ৩৫৫ হেক্টর, কুষ্টিয়ায় ৯ হাজার ১৫০ হেক্টরের বিপরীতে ১১ হাজার ৬৪৫ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গায় ২ হাজার ৮০০ হেক্টরের বিপরীতে ৩ হাজার ১৩৫ হেক্টর ও মেহেরপুর জেলায় ৪ হাজার ৩৭০ হেক্টরের বিপরীতে ৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, অন্যান্য বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম সরিষা আবাদ হলেও এবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে বেশি সরিষা আবাদ হয়েছে। সরিষা আবাদের জন্য আবহাওয়া ভালো হওয়ায় কৃষকরাও বেশ আশান্বিত।
যশোর সদর উপজেলার সুলতানপুর মাঠে কথা হয় চাষি আসাদুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, এবার তাদের মাঠে ১৭০ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এসব ক্ষেতে টরি-৭ ও টরি-১৪ নামের উন্নত জাতের সরিষার দুটি জাত আবাদ হয়েছে। তিনি বলেন, এবছর সরিষা চাষের জন্য আবহাওয়া শতভাগ অনুকূলে।
সরিষা বপণের সময় প্রয়োজনী বৃষ্টি পাওয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। শেষমেষ ফুল ও ফল আসা পর্যন্তও কোনো বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবছর নিকট-অতীত যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশা করেন।
একই মাঠে কথা হয় চাষি মাহফুজ বিল্লাহ ও রুবায়েত হোসেনের সাথে। তারা বলেন, এবছর সয়াবিনসহ যাবতীয় ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় অধিকাংশ কৃষকরা সরিষা আবাদের প্রতি ঝুঁকেছেন। ধান চাষে কখনও লাভ কখনও লোকসান হওয়ায় কৃষকরা চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় তারা সরিষা আবাদ করে লাভ করবেন বলে আশা করছেন।
কৃষক মাহফুজ বিল্লাহ ও রুবায়েত হোসেন বলেন, ধানসহ অন্য ফসলে খরচ বেশি লাভ কম। অথচ সরিষা চাষে খরচ কম লাভ বেশি। এক বিঘা জমিতে বীজ, সার, সেচ ও মাড়াই করে বাজারে তোলা পর্যন্ত খরচ হয় ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সেখানে এক বিঘা জমিতে সরিষার ফলন হয় ৪ থেকে ৫ মণ। প্রতিমণ সরিষা বাজারে ৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অলিয়ার রহমান নামে আরেক কৃষক বলেন, সরিষা আবাদের পাশাপাশি একই মৌসুমে কৃষক আমন ও বোরো আবাদ করে বাড়তি মুনাফা পাচ্ছে। সাথে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন সবজির আবাদ করেও তারা লাভ হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় অনেক চাষিই এখন ধান আবাদের পাশাপাশি সরিষা আবাদ করে। দ্বিগুন লাভ করছে।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক বলেন, চলতি মৌসুমে যশোরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ হাজার ৮৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। যা কৃষির জন্য খুবই ইতিবাচক। তিনি বলেন, জমির ঊর্বরতা ধরে রাখার জন্য শস্য নিবিড়তার জন্য কৃষককে সরিষা আবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ সরিষা আবাদ করে একই জমিতে সহজেই তিন ফসলের চাষ করা সম্ভব। এজন্য অধিকাংশ কৃষককে সরিষা আবাদের জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোরাঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকার ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে রবি ফসলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য যশোরসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অন্য ফসলের সাথে সরিষা আবাদের চাষির সংখ্যা বাড়ছে। এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষার ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশা করেন।