নিজস্ব প্রতিবেদক
অবশেষে হেরে গেলেন সময়ের সঙ্গে লড়ে চলা এক যোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা, দৈনিক সংবাদের বিশেষ প্রতিনিধি যশোরের সিনিয়র সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে তাঁর হার্টে তিনটি রিং স্থাপন করা হয়। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে তিনি প্রিয় শহর যশোরে ফিরে আসেন। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় তিনি আবার অসুস্থবোধ করলে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মরদেহ শহরের খালধার রোডস্থ বাড়িতে নেওয়া হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী কন্যাসহ অসংখ্য গুনাগ্রহী রেখে গেছে।
সাংবাদিকতা ও মুক্তিযুদ্ধ দুই ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য এক মানুষ। মুক্তচিন্তার সাহসী কণ্ঠস্বর আর কলমের মাধ্যমে সমাজকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গতকাল তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে যশোরের আকাশ থেকে ঝরে গেল আরো একটি নক্ষত্রের।
আজ দুপুর ১২ টায় সিনিয়র এই সাংবাদিক ও বীরমুক্তিযোদ্ধার মরদেহ প্রেসক্লাব যশোরে নেওয়া হবে। সেখানে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তার কফিনে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে এই বীরমুক্তিযোদ্ধার গার্ড অব অনার ও নামাজে জানাজা শেষে শহরের কারবালা কবরস্থানে সমাহিত করা হবে।
গত ২৭ জুলাই সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকার ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষায় তার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। কিন্তু শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ডাক্তাররা তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য দেন এবং ১০দিন পর হার্টে রিং স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট ঢাকার ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে যান। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ১৯ আগস্ট তার হার্টে ৩টি রিং স্থাপন করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার তাকে যশোরে নেওয়া হয়। এরপর দিনই তিনি মারা গেলেন।
রুকুনউদ্দৌলাহর পিতার নাম মরহুম মোকসেদ আলী। তিনি দৈনিক কল্যাণের সম্পাদক ও প্রকাশক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ দ্দৌলার অনুজ। এবং দৈনিক কল্যাণের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এহসান-উদ-দৌলা মিথুনের চাচা। রুকুনউদ্দৌলাহ দৈনিক কল্যাণের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন।
জেষ্ঠ্য সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ ১৯৬৫ সালের ২০ মার্চ ভারতের ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানায় জন্ম গ্রহণ গ্রহন করেন। নওগাঁ সরকারি কেডি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং সরকারি এমএম কলেজ (যশোর) থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ¯œাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন।
শৈশব-কৈশোর কেটেছে নওগাঁয়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে নওগাঁয়। সেখানে থাকতেন অগ্রজ আসফউদ্দৌলার কাছে। নওগাঁ কেডি স্কুলে পড়াকালীন বেজে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের দামামা। রাজনৈতিক সচেতন রুকুনউদ্দৌলাহ পরিবারের সাথে চলে যান ভারতে। সেখানে শিলিগুড়িতে প্রশিক্ষণ শেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ধর্ম, মানবতা, সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ঢোকেননি এক মুহূর্তের জন্যেও। তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম ‘দৈনিক সংবাদ’ এর সাথে জড়িত চার দশক ধরে।
‘সংবাদ’ এ তার নিয়মিত কলাম ‘গ্রাম-গ্রামান্তরে’ বেশ জনপ্রিয়। তিনি চ্যানেল আই, রেডিও টুডেতে কাজ করেছেন। যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্ফুলিঙ্গ, দৈনিক ঠিকানা, দৈনিক রানার ও দৈনিক কল্যাণে বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে যশোর থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক যশোরের কাগজ’র সম্পাদক। এছাড়া তিনি প্রেসক্লাব যশোর ও যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন।
সাংবাদিকতা পেশায় সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন আইডিই পুরস্কার, যশোর শিল্পী গোষ্ঠী পদক, জ্ঞানমেলা পদক এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন বই। শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ‘গ্রাম-গ্রামান্তরে’, নবযুগ প্রকাশনী থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর’ নবরাগ প্রকাশনী থেকে ‘আমার কৈশোর আমার মুক্তিযুদ্ধ’ ‘মানুষের ভাবনা মানুষের কথা’ এবং ‘ছোট ছোট কথা অচেনা মানুষ’ ‘জনতার গভর্নর’ ‘দেশ জনতার খ-চিত্র’ ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা’ ‘গাঁও গেরামের কথা’ অরিত্র প্রকাশনী থেকে ‘যশোর রোড ১৯৭১’ ‘হাতাহাতি যুদ্ধ ১৯৭১’ নামে বই প্রকাশিত হয়েছে। একসাথে আমার কৈশোর আমার মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের ইংরেজি ভার্সনও প্রকাশিত হয়েছে।