আবদুল কাদের
যশোর জেলায় গেল অর্থবছরে (২০২১-২২) সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে অস্বাভাবিক নগদ অর্থ লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে, গেল বছরে যশোরের ব্যাংকগুলোতে ৩২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, স্বর্ণসহ চোরাচালানকাজে বেশি ব্যবহার হয়েছে এসব অর্থ।
কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকা বা এর বেশি নগদ জমা অথবা উত্তোলন হলে সেটিকে চিহ্নিত করা হয় ক্যাশ ট্রানজেকশন (সিটিআর) বা নগদ লেনদেন হিসেবে। ব্যাংকগুলোর বিএফআইইউতে এ ধরনের লেনদেনের তথ্য জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও অপরাধ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় টুল বা মাধ্যম হলো সিটিআর।
এসব জেলায় নগদ লেনদেন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধকে দায়ী করছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। এর কারণে জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। সীমান্ত এলাকাগুলো এখন মাদক ও মানব পাচার, চোরাচালানের মতো অপরাধগুলোর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ কারণে এসব এলাকায় অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁকিও বেশি। সীমান্ত এলাকায় বড় অংকের লেনদেন এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর তুলনামূলক একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও। তাদের ভাষ্যমতে, সীমান্তে মাদক ও মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো আগেও অনেক বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। এখন এর পাশাপাশি চোরাচালানের মতো অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের ব্যাপ্তিও এখন বাড়ছে। বিশেষ করে ডলার সংকট দেখা দেয়ার পর থেকে মুদ্রাটিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় কেউ কেউ ঝুঁকে পড়ছেন অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের দিকে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিল্পবে নেতৃত্ব দেবে: আইসিটি প্রতিমন্ত্রী
এখন যশোরের আলোচিত বিষয় হলো স্বর্ণচোরাচালান। জেলাটির রুট হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত স্বর্ণ পাচার করছে চোরাকারবারিরা। গতবছর বিজিবির যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা উদ্ধার করেছে প্রায় সাড়ে ৭৯ কেজি স্বর্ণ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজিবির যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মিনহাজ সিদ্দিকী।
জেলাটিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে নগদ অর্থের লেনদেন বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এ সময় জেলাটিতে মোট নগদ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।
যশোরে নগদ অর্থের লেনদেন বেড়ে যাওয়ার পেছনে সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় ব্যাংকাররাও। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) খুলনা-বরিশাল জোনপ্রধান ফকির আক্তারুল আলম বলেন, সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় যশোরে চোরাচালান হয় বেশি। এখানে নগদ টাকার লেনদেনও বেশি। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক শাকিল আহমেদ বলেন, বর্তমান সময়ে সব পণ্যর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। যেকারণে নগদ টাকা বেশি প্রয়োজন হচ্ছে। তবে সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় জেলাটিতে স্বর্ণচোরাচালান হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ উদ্ধার হচ্ছে, যা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি। এসবকাজে নগদ লেনদেন হয়ে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, সীমান্তে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য মতে, পাচারকালে যে পরিমাণ মাদক বা অবৈধ পণ্য ধরা পড়ে, নিরাপদে সীমান্ত পার হয় এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে পাচারকৃত দ্রব্য কেনাবেচা হয় সাধারণত স্থানীয় মুদ্রায়। সীমান্তবর্তী সূত্র ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এখন বাংলাদেশী টাকার চাহিদা বেড়েছে। সেখানকার অনানুষ্ঠানিক পন্থায় পণ্য রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন পণ্যের মূল্য হিসেবে বাংলাদেশী টাকা গ্রহণ করছেন। স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত বাংলাদেশিরা এ টাকা আবার গ্রহণ করছেন পাচারকৃত পণ্যের মূল্য হিসেবে। আবার বাংলাদেশ থেকে স্থল সীমান্তে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে গিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং (আমদানি পণ্যের পরিমাণ কম দেখানো) ও হুন্ডির মাধ্যমেও টাকা পাচার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্ত পার হয়ে দুই দেশেই প্রবেশ করছে প্রচলিত ও নিষিদ্ধ নানা ধরনের পণ্য। এ তালিকায় চাল, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিস্ফোরক ও মাদকের মতো নিষিদ্ধ পণ্যও। ভারত থেকে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে গবাদিপশু, মাদক, কসমেটিকস, শাড়ি ইত্যাদি দ্রব্য। আবার বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে তুলা, কাপড়, চামড়া, স্বর্ণ, মাছ, ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার পার্টস, সার, জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্য।
বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আর্থিক অপরাধ চিহ্নিত ও তা প্রতিরোধ করতে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। যেমন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এ ধরনের তৎপরতা চালাতে যেকোনো একটি ব্যাংকের শাখাকে লিড ব্যাংক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এরপর ওই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় স্থানীয় ব্যাংকের শাখাগুলোকে নিয়ে সীমান্তকেন্দ্রিক আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধে সভা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতেও এ ধরনের কার্যক্রম চালু থাকবে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও নিয়মিতভাবে সীমান্তকেন্দ্রিক সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য দিচ্ছে বিএফআইইউ।
এব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হুসাইনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ডিবি পুলিশের ওসি রুপন কুমার জানান, স্বর্ণচোরাচালান রোধে পুলিশ কাজ করছে। সীমান্ত কেন্দ্রীক যেকোন অপরাধ দমনে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
আরও পড়ুন: বংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ আইএমএফের