নিজস্ব প্রতিবেদক
নতুন বছরের ২৮ দিন পেরিয়ে গেলেও যশোরে চাহিদা অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবই এখনো পৌঁছায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। বই উৎসবে প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের হাতে যে দুই থেকে তিনটি করে বই তুলে দেয়া হয়; তারপর আর কোন বই দেয়া হয়নি। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরে আংশিক বই বিতরণ হয়েছে। নতুন বই পায়নি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বই সংকটের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। বিদ্যালয়ে এসে খেলাধুলা করেই ফিরে যাচ্ছেন তারা। তবে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ব্যতিক্রম উদ্যোগে ইন্টারনেট থেকে বইয়ের কনটেন্ট সংগ্রহ করে মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বই না পেলেও শিক্ষার্থীরা মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাসের পড়াগুলো খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
যশোরে জেলার ১ হাজার ২৮৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইয়ের চাহিদা ছিল ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ১১০ পিস। বই উৎসবের দিন বিতরণ করা হয় ৮ লাখ ২৭ হাজার ২৭ হাজার ৭১৬ বই। বিতরণের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। তারপর আর কোন বই আসেনি। তবে চলতি সপ্তাহে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ বই বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম। ৫৩৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বইয়ের চাহিদা ছিল ২৭ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৬ পিস। বই উৎসবে দিন বিতরণ করা হয় ১০ লাখ ৩২ হাজার ৫৬৯ পিস। বর্তমানে বই আসার সংখ্যা ১২ লাখ। প্রাপ্তির হার ৭২ শতাংশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের প্রথম দিন বই উৎসবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোথাও দুটি আবার কোথাও তিনটি বই বিতরণ করা হয়। আর প্রাক-প্রাথমিকে কোথাও খাতা দেওয়া হলেও বই দেওয়া হয় না। আবার বই দেওয়া হলেও খাতা দেওয়া হয়নি। মাধ্যমিক স্তরে সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিন থেকে চারটি বই দেওয়া হয়। তবে বই উৎসবে বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির কোন বই দেওয়া হয় না। এর সপ্তাহখানিক পরে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে তিনটি করে বই ও অন্যান্য শ্রেণিতে আরো দুই থেকে তিনটি করে বই দেওয়া হয়। বর্তমানে সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ বই বিতরণ করা হয়েছে। দ্ইু শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে ষষ্ঠশ্রেণিতে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন কারিকুলামে বই ছাপানোর কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি বই পেতে দেরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: দুর্নীতি রোধে জেলা প্রশাসকদের নির্মোহ ভূমিকা প্রয়োজন
জেলার কেশবপুর মাইকেল মধুসূদন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চশ শ্রেণিতে তিনটি, চতুর্থ শ্রেণিতে তিনটি বই দেওয়া হয়েছে। তিনটি ক্লাস শেষ হওয়ার পরে ওই বিদ্যালয়ের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খেলাধুলা করতে দেখা যায়। গত বৃহস্পতিবার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুদিপ্ত, জিৎকুন্ড জানান, তাদের সমাজকর্ম, ধর্ম ও ইংরেজি এই তিনটি বই দেওয়া হয়েছে। এতোদিন এই তিনটি ক্লাসই হচ্ছে। এর পরে ছুটি না দিলেও খেলাধুলা করি। যশোর শহরের ইনস্টিটিউট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, তিনটি বিষয়ের বই পেয়েছি। প্রতিদিন এই তিনটি ক্লাসই হয়। সুলতান আহমেদ নামে ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, এখনো বই পায়নি সন্তানেরা। পুরোপুরি ক্লাসও হচ্ছে না। পুরোপুরি ক্লাস না হওয়ায় তারে স্কুলেও পাঠাচ্ছি না।
ঝিকরগাছা এমসিডি সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৭০ শতাংশ বই পেয়েছি। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণির বই কয়েকটি পেয়েছি। এছাড়া অন্য শ্রেণিতে বই বাকী থাকলেও পুরনো বই দিয়ে ক্লাস নিচ্ছি। কাশিপুর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সবুর বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে তিনটা বই পেয়েছি। কিছু কিছু বই বাকী আছে। তবে আমরা ইন্টারনেট থেকে ইউটিউব ও বইয়ের কনটেন্ট সংগ্রহ করে মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নিচ্ছি। তবে পুরোপুরি বই না থাকায় ক্লাস নিতে অসুবিধা এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন। মণিরামপুরের রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক বিশ^াস বলেন, প্রতিটি ক্লাসেই ৬-৭টি করে বই পেয়েছি। পুরো বই না পাওয়ায় কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। ঝিকরগাছার কেনায়েত আলী রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার রায় বলেন, প্রাক-প্রাথমিকের খাতা পেলেও বই পায়নি। তার বিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করা হয়েছে। নিউটাউন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরাইয়া শিরিন। তিনি জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৩টি, ৭ম শ্রেণিতে ৪টি, ৯ম শ্রেণিতে মানবি ও বিজ্ঞানের অর্ধেক বই এসেছে। ব্যবসায়ী শিক্ষা শাখার কোন বই না আসায় এ শাখার শিক্ষার্থীরা এখনও তাদের লেখাপড়া শুরু করতে পারেনি। একই অবস্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। সেখানে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক বই এসেছে। শিক্ষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করছেন বলে জানান শহীদ স্মরণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাদৎ হোসেন বাবু। তিনি জানান বই না থাকায় শিক্ষার্থী এখনও মনযোগ সহকারে লেখাপড়া করতে পারছেন না।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম গোলাম আযম বলেন, জেলায় মাধ্যমিকে বই প্রাপ্তির হার ৭২ শতাংশ। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বই আসছে দ্রুতই সব দেওয়া হবে। অন্য শ্রেণির বইগুলো প্রায় সব দেওয়া হয়েছে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই পায়নি; তাদের নতুন বই দিয়ে ভাগাভাগি করে আর পুরনো বই দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া জানুয়ারিতে তেমন ক্লাস হয় না; বিভিন্ন খেলাধুলার ইভেন্ট চলে। ফলে জানুয়ারিতে বই না পেলে সমস্যা তেমন একটা হবে না। ফেব্রুয়ারিতেই সব বই পাওয়া যাবে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম বলেন, মোট কত শতাংশ বই পেয়েছি এই মুহূর্তে এটা বলতে পারছি না। তবে চলতি সপ্তাহে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পাবে বলে তিনি দাবি করেন।
আরও পড়ুন: যশোরে বিষাক্ত নেশাদ্রব্যে যাচ্ছে প্রাণ