শাহাদত হোসেন কাবিল
দৃশ্যপট যশোর পুলিশ সুপারের অফিস। এক গ্রাম্য বৃদ্ধা দুটি ঝুনো নারকেল হাতে ঘোরাঘুরি করছেন। বেশখানিক সময় তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে সেন্ট্রি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, এখানে ঘোরাঘুরি করছেন কেন ? বৃদ্ধা বললেন, এই অফিসের বড় সাহেবকে আমি নারকেল দুটি দেবো।
সেন্ট্রি জানালেন, এখন হবে না। বৃদ্ধা বললেন, নারকেল দুটো তাকে দিতেই হবে।
সেন্ট্রি বৃদ্ধার নাছোড় ভাব দেখে ভেতরে গিয়ে বড় সাহেবকে সব জানালেন। কথা শুনে এক সেকেন্ড দেরি না করে বেরিয়ে আসলেন। বৃদ্ধার কাছে গিয়ে নারকেল দুটি নিয়ে ভেতরে গেলেন। নিজ হাতে মুখের ঘাম মুছে দিয়ে বললেন, বুড়ি মা নারকেল এনেছেন কেন ?
বৃদ্ধা বললেন, আমি গ্রাম থেকে তোমার সুনামের কথা শুনেছি। তুমি যশোর থেকে চলে যাচ্ছ, তাই নারকেল দুটো তোমার জন্য এনেছি। আমার দেয়ার মত আর কিছু নেই।
নারকেল না এনে আমার জন্য শুধু দোয়া করলেও হতো। এরপর বৃদ্ধাকে বিদায় দিয়ে বড় সাহেব চোখের পানি মুছলেন। ও দিকে বৃদ্ধাও আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে যাবার সময় বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন।
এই বড় সাহেব হলেন যশোরের সাবেক জননন্দিত পুলিশ সুপার আবদুর রউফ। তিনি মানুষের হৃদয় কিভাবে জয় করেছিলেন তা ওই বৃদ্ধার ঘটনা থেকে বোঝা যায়। এই জননন্দিত পুলিশ সুপার আর নেই। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। গত সপ্তাহে তাকে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় সেখানকার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
১৪ সেপ্টেম্বর বাদ ফজর কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে প্রথম জানাজা এবং বাদ যোহর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয় ।
পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুর রউফ একজন ধার্মিক এবং সরল মনের মানুষ ছিলেন। স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনি করে গেছেন। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় পরিবারের পক্ষে দোয়া চাওয়া হয়েছে।
যশোরে পুলিশ সুপার হিসেবে ১৯৯৯ সালে কর্মরত ছিলেন আবদুর রউফ। সে সময় তিনি সন্ত্রাস ও চরমপন্থী অধ্যুষিত ভয়ঙ্কর জনপদ যশোরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। যশোরবাসীর কাছে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় পুলিশ সুপার। যশোর থেকে তার বদলির আদেশ আসলে সে সময় সর্বশ্রেণি পেশার মানুষ তার বদলি যেন না হয় সেজন্য মিছিলও করেন।
এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা কথা বলি। তখন আমি স্পন্ডোলাইসিসে (ঘাড়ের ব্যথা) আক্রান্ত হই। এ রোগে আমার ঘাড় বাকা হয়ে গিয়েছিল। আমার এ অসুস্থতার সুযোগে যশোরের এক তরুণ চাঁদাবাজিতে নামে। আমাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা তুলতে থাকে। যাদের কাছ থেকে টাকা নেয় তাদের মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের ডিডি অন্যতম। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তার কাছে গেলে তিনি ঘটনা স্বীকার করেন এবং আইনের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেন। তার কথা মত যাই পুলিশ সুপার আবদুর রউফের কাছে। সাথে ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ। আমি সব ঘটনা তার কাছে খুলে বললাম, সুচের অগ্রভাগে যতটুকু পানি ধরে সাংবাদিকতা জীবনে ততটুকু অপরাধও আমি করিনি। আমার এই অর্জন যেন বিসর্জনে না যায় সে বিষয়ে বিনীতভাবে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আমি কথা বলার ফাঁকে তার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শেষমেষ তিনি আমাকে বললেন, দু’একের মধ্যে আপনি ফল পাবেন। প্রসঙ্গত দুদিনের মাথায় সেই চাঁদাবাজ গ্রেফতার হয়।
যশোরের শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরির এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি। সাংবাদিক হিসেবে অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এক পর্যায়ে বলেন, আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের বাসার পাশের বাসায় প্রতি রাতে ওই বাসায় মহিলা হাউমাউ করে কাঁদতেন। আমার মায়ের কাছে জানতে চাইতাম ওই মহিলা রোজ রাতে কাঁদে কেন। মা বলতেন মহিলার স্বামী মাতাল। প্রতি রাতে মদ খেয়ে বাসায় ফিরে বউ পেটায়। মাকে বলতাম, মদ কি?
মা বলতেন, মদ এমন এক জিনিস তা যে হাতে স্পর্শ করা হবে সে হাত বেহেস্তে যাবে না।
মার ওই কথা আমার আজো মনে আছে। আমি লেখাপড়া শেষ করে পুলিশে চাকরি নিয়েছি। হয়েছি কর্মকর্তা। মাদকদ্রব্য বিরোধী বহু অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছি। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর মাদক। কিন্তু আমি একদিনের জন্য একটিবারও মদ স্পর্শ করিনি।
যশোর শহরের যানজট সমস্যা দীর্ঘদিনের এক সমস্যা। বিশেষ করে ক্যালট্যাক্সের সামনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ সমস্যার জন্য বড় দায়ী। এজন্য আইন শৃংখলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত লিখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ব্যয়ই সার হয়। সবশেষে পুলিশ সুপার আবদুর রউফ এগিয়ে আসেন। তিনি একদিন ওই জায়গায় গিয়ে সব চালকদের ডেকে বলেন, এই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে করা হয়েছে। আমি আগামী পরশু এসে যেন না দেখি এখানে স্ট্যান্ড আছে। উল্লেখ্য, তিনি ওই স্থান থেকে চলে যাবার সাথে সাথে স্ট্যান্ডটি সরিয়ে নেয়া হয়। এটা সম্ভব হয়েছিল পুলিশ সুপারের ওই বলার মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। শুধু ওই স্ট্যান্ডটি নয় তিনি শহরের ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে নিজেই দড়াটানা ও খুলনা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ট্রাফিকের ভূমিকা পালন করতেন।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল ময়দানে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর তিনি যশোরে পুলিশ হিসেবে যোগদান করেন। সন্ত্রাস ও চরমপন্থী অধ্যুষিত যশোরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনেন। চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণের আওতায় আনেন। এই অঞ্চলের শীর্ষ সন্ত্রাসী হাসান মিজানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। মাদকের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এসব কাজ সফলতার সাথে সম্পন্ন হলেও কেউ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়নি। বই পড়ার ব্যাপারে বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্ধুদ্ধ করতেন। তার দরজা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিলো।
তিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইভটিজিং বিরোধী প্রচারণা চালাতেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যা করেছেন তা অতুলনীয়।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক,দৈনিক কল্যাণ