আবদুল কাদের
যশোর শহরের বেজপাড়া বিহারী কলোনী এলাকায় অন্তত ২০০ লোকের জটলা। এর মধ্যে একজনের বেশভূষা দেখে চক্ষু চড়কগাছ, পরনে শার্ট, জিন্স প্যান্ট আর স্যান্ডেল সু। এক হাতে স্মার্টফোন, সেই সাতসকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সাজ্জাদ হোসেন। অনার্স পড়ছেন সিটি কলেজে। বাবা একটি টায়ারের দোকানের চাকরি করেন। জানা গেল, মায়ের কথায় সাজ্জাদ দাঁড়িয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএসের (খোলাবাজার) সারিতে। করোনার ছোবল আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তার পরিবার এখন দিশেহারা। কিছু টাকা সাশ্রয় করতে ভর্তুকি মূল্যে আটা কিনতে এসেছেন তিনি।
গতকাল সকাল ৮টা শহরের চারখাম্বার মোড়। সারিতে আছেন জানান দিতে কমপক্ষে শতাধিক নারী ইট পেতেছেন ফুটপাতে। আরও একশ জনের মতো পুরুষ সারিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তাদের অনেকেরই কাটেনি ঘুমের ঘোর। ঘুম তাড়াতে কেউ মেতেছেন গল্পে, কেউ হাঁটছেন এদিক-সেদিক। বাজারে নিত্য পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের ওএমএস’র ডিলারদের কাছে নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড় বাড়ছে।
খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সরকার স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করছে। যশোর পৌর এলাকায় ১৪ জন ডিলারের মাধ্যমে এসব চাল-আটা বিতরণ করা হচ্ছে। প্রতিজন ৫ কেজি করে সপ্তাহে একবার করে চাল-আটা ক্রয়ের সুযোগ পাচ্ছে। শুক্রবার ও শনিবার (সরকারি ছুটির দিন বন্ধ) বাদে সপ্তাহে ৫দিন ডিলাররা চাল-আটা বিক্রি করে থাকেন। একজন ডিলার ৭৫৫ কেজি করে এই চাল-আটা সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। তারা ১৭১ জন স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। চাল ৩০ টাকা ও আটা ২৪ টাকা কেজি দরে ক্রেতারা কেনার সুযোগ পান।
ওএমএস’র পণ্য কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম বলেন, স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। ছেলে সংসারে থাকি। তার আয় স্বল্প, একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারি হিসেবে কর্মরত। যে আয় করেন তা দিয়ে সংসার চলে না। একারণে অল্প দামে আটা কেনার জন্য লাইনে রয়েছি। শহরের ঘোপ এলাকার রফিকুল নামে অপর যুবক বলেন, তার বাবা ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করে। ভাড়া বাড়িতে থাকে। বাজারে সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক। যেকারণে অল্পদামে চাল কিনতে এসেছি। ৫ কেজি চাল আমাদের সপ্তাহে ভালোভাবে হয়ে যাবে।
পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওএমএস ডিলার গোলাম মোস্তফা জানান, সপ্তাহে ৫ দিন আমরা চাল-আটা বিতরণ করে থাকি ১৭১ জনের মধ্যে। কিন্তু লাইনে দাঁড়ান প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ মানুষ। যাদেরকে দেয়া সম্ভব হয় না তাদেরকে পরের দিন অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মোট কথা যে পরিমাণ আমাদেরকে চাল-আটা বরাদ্দ দেয়া হয় তা অপ্রতুল। প্রতিদিন ওএমএস’র চাল-আটা কিনতে লাইনে মানুষের ভিড় বাড়ছে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বারবার বলছি। কমপক্ষে প্রতিদিন ৩শ মানুষের জন্য বরাদ্দ বাড়ালে আমাদের ঝামেলা পোহাতে হয় না।
আরও পড়ুন: স্কুল শিক্ষিকাকে লাথি মারা সেই ট্রেন পরিচালক বরখাস্ত
ঝুমঝুমপুরের ওএমএস’র ডিলার নতাই চন্দ্র সাহা বলেন, প্রতিদিন আমাদের লাইনে সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ মানুষ দাড়ায়। এরমধ্যে আমরা ১৭১ জনকে দিতে পারি। এরমধ্যে আমাদের স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের চাপ থাকে। যেকারণে সবাইকে দেয়া সম্ভব হয় না। এতে বিশৃঙ্খল সৃষ্টি হয়। এজন্য আমরা সরকারের কাছে ওএমএস’র বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।
তবে সরকারের বরাদ্দ করা সব চাল-আটা সুবিধাভোগীদের কাছে বিক্রি না করে অন্য জায়গায় বেশি দামে বেচে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৫০ থেকে ৫২ টাকা এবং আটা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। সেই হিসাবে একজন ক্রেতার ওএমএসের চাল-আটায় সাশ্রয় হয় গড়ে ৩০০ টাকা। এই সাশ্রয়ের জন্য তাদের লাইনে দাঁড়াতে হয় সেই কাকডাকা ভোরে। অপেক্ষায় থাকতে হয় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।
খোদেজা বেগম বলেন, বাজারে তেল চিনির দাম বেড়েছে। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষের পক্ষে এক সাথে ৫ লিটার তেল কেনার সামর্থ নেই। কিনি পামওয়েল। এতে অসুখ-বিসুখ হয়। ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না। ডিমের ডজন ১৫০ টাকা হয়ে গেছে। আটাও ৭০ টাকা কেজি। বাঁচমু কিভাবে।
শহরের বকচর এলাকার রিনা বেগম ওএমএসের পণ্য কিনতে এসে বলেন, বাসাবাড়িতে কাজ করি। দুই মেয়ে পড়াশোনা করে। ভাড়া থাকি, স্বামী গাড়ি চালিয়ে ১০-১২ হাজার টাকা পান। এটা দিয়ে লেখাপড়া আর সংসারের পুরা মাসের খরচ হয় না। আসতে অস্বস্তি লাগে, তাও আসি। আবার যখন দেখি, অনেকের বাসাবাড়ি আছে, তারাও লাইনে দাঁড়ান। তখন সাহস পাই।
চাহিদা বেশি আটায় : চালের পরিমাণ বেশি থাকায় ক্রেতারা মোটামুটি কিনতে পারেন। তবে ট্রাকে চালের অর্ধেক থাকে আটা। ফলে দুপুরের আগেই আটা শেষ হয়ে যায়। এ কারণে খুব ভোরে না দাঁড়ালে আটা মেলে না। খালি হাতে ফেরেন অনেকে, লাইনে দাঁড়ালেও সবার ভাগ্যে জোটে না পণ্য। প্রতিদিনই অনেককে ফিরতে হয় খালি হাতে।
এব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু জানান, ওএমএস’র চাল-আটার চাহিদার কারণে আমরা ১৪ জন ডিলারকে এক টন বরাদ্দ বাড়িয়েছি। এখন ১৯ টন পণ্য দেয়া হচ্ছে। ১৩ জন ডিলার বরাদ্দ পেয়ে থাকেন ৭৫৫ কেজি করে। আর একজন পান ৮৫৫ কেজি। ওএমএস ডিলারের লাইনে মানুষের ভিড় বাড়ছে বলে জেনেছি। আমরা খোঁজ নিয়ে বরাদ্দ কিভাবে আরও বাড়ানো যায় সেটি দেখব।
যশোর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোকসিমুল বারী অপু জানান, প্রতিদিন ওএমএস’র ডিলারদের দোকানে মানুষ ভিড় করছে। টোকেন নিতে আমাদের মতো জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার আসছেন তারা। ঠিকমত পণ্য না পাবারও অভিযোগ করেন ক্রেতারা। সরকারের কাছে আমাদের দাবি এখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
আরও পড়ুন:বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ যশোরের ডিসির
১ Comment
Pingback: লবণ পানিতে উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীব বৈচিত্রে হুমকি