বার্মিজ, পেঙ্গুইন, মাছরাঙা, সাকি ছুরির ব্যবহার বেশি
দু’মাসে ১৫টি ছুরি মারার ঘটনা আছে, নিহত ৫ জন
লাবুয়াল হক রিপন
যশোর শহরে শিশু-কিশোরদের পকেটে পকেটে এখন চকচকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ‘খোঁচা’ (ছুরি-চাকু)। ছিঁচকে সন্ত্রাসী, ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার, মাদক কারবারি, এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও খোঁচা নিয়ে ঘোরাঘুরি করে, মাস্তানি করে। এগুলো সহজলভ্য হয়ে ওঠায় তুচ্ছ কারণে খোঁচার আঘাতে প্রতিপক্ষকে হত্যাও করছে কিশোর সন্ত্রাসীরা। গত দুই মাসে খোঁচার আঘাতে ৫ কিশোর ও যুবক খুন হয়েছে। ছুরিকাঘাতে আহতের ঘটনা রয়েছে ৮-১০টি।
যশোর অঞ্চলের কিশোর-কিশোররা অনেকেই চাকুকে ‘খোঁচা’ বলে থাকে। এই খোঁচার রকমফের রয়েছে। বার্মিজ, পেঙ্গুইন, মাছরাঙা, সাকি-এই চার রকম খোঁচাই শিশু-কিশোররা ব্যবহার করছে। চিকন ফলার চাকুর নাম মাছরাঙা। দুই দিকে ধারালো চাকুর নাম বার্মিজ চাকু। দুই হাতলওয়ালা জাপানি চাকু তথা খোঁচাও রয়েছে। তবে সন্ত্রাসীদের কাছে সাকিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। পুলিশ যত্রতত্র চাকু বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও শহরের বিভিন্ন বাজারে এসব চাকু বিক্রি হয়।
জানতে চাইলে যশোর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) বেলাল হোসাইন বলেন, ছুরি-চাকুর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ঝটিকা অভিযান শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে ছুরি-চাকু উদ্ধারে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া ক্রোকারিজ শপ ও দোকানগুলোতে ছুরি-চাকু ক্রেতার ছবি, নাম-ঠিকানা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ছুরি-চাকুর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলমান রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে ছুরি-চাকু উদ্ধারে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। দোকানগুলোতে ছুরি-চাকু ক্রেতার ছবি, নাম-ঠিকানা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। -বেলাল হোসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, যশোর
কিন্তু প্রশাসনের এই উদ্যোগের মধ্যেও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছাত্রসংগঠনের দ্বন্দ্ব, ছিনতাই, নানামুখী অপরাধে, বার্মিজ ও ছুসিহ নানা ধরনের ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়তই। ঘটছে প্রাণহানি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র মতে, ২৬ জানুয়ারি যশোর শহরের টিবি ক্লিনিক মোড়ে সোলায়মান হোসেন নামে এক যুবক খুন হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাতে খুন করে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এই ঘটনায় নিহতের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যশোর শহরের রেল স্টেশন এলাকায় জুম্মান নামে এক সন্ত্রাসীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মামুন সরদার ১৩ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে।
১০ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোর শহরের বারান্দীপাড়া বারান্দীপাড়া মেঠো পুকুরপাড়ে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে আহত ইঞ্জিন চালিত রিকসা চালক টগরকে হত্যা করে এলাকার দুর্বৃত্তরা।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর বালিয়াডাঙ্গায় নাবির হোসেন নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। এই ঘটনায় দুইজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মামলা করেছে নাবিরের মা।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোরের অভয়নগরে মুরাদ হোসেন নামে স্থানীয় যুবলীগের এক নেতাকে হত্যা করা হয়। তাকেও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় অভয়নগর থানায় মামলা হয়েছে। দুই আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে।
এছাড়াও গত ৪ ফেব্রুয়ারি সদা উপজেলার ছোট গোপালপুরে জাহিদুল ইসলাম নামে এক রাইস মিল শ্রমিক আহত হন। একই দিনে রামনগর পুকুরকুলে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে আহত হন আল আমিন নামে এক যুবক। ১০ ফেব্রুয়ারি শহরের বারান্দী মোল্যাপাড়ায় ওহিদুল ইসলাম নামে একজনকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। ১১ ফেব্রুয়ারি শহরতলীর খোলাডঙ্গা গ্রামে তুষার কেষ নামে এক স-মিল মালিককে ছুরিকাঘাত করা হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি শহরের নীলগঞ্জে দুর্বৃত্তদেও ছুরিকাঘাতে আহত হন ইমরান হোসেন নামে এক যুবক।
এই সকল ঘটনার পরে পুলিশ ৩ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে শহরের রেলগেট এলাকার থেকে চাকুসহ দুই দুর্বৃত্তকে আটক করে। একদিন দুইটি চাকুসহ বারান্দী নাথপাড়া এলাকায় পুলিশ আটক করে মামুন ও অমিত নামে দুই দুর্বৃত্তকে। ১৭ ফেব্রুয়ারি বারান্দীপাড়া এলাকা থেকে ইয়াছিন আরাফাত নামে এক দুর্বৃত্তকে একটি চাকুসহ আটক করে পুলিশ।
ছুরিকাঘাত ছাড়াও গত ২ ফেব্রুয়ারি চোর সন্দেহে ১১ ফেব্রুয়ারি রাজারহাটের রামনগরের সুতিঘাটা ফয়জুল গাজী নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকার কয়েকজন লোক। এই ঘটনায় মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে কয়েকজন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রাম থেকে রিকশা চালক বাদশা মিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিখোঁজের তিনদিন পর পুলিশ ওই লাশের সন্ধান মেলে। এই ঘটনায় মামলা হলেও কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার মালিডাঙ্গা গ্রামে নাইমুর রহমান হিমেল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আদালতে মামলা করেছেন। কিন্তু কাউকে আটক বা হত্যার কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
২ জানুয়ারি বিকেলে নিজ বসতঘর থেকে শাহ আলম নামে এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কি কারণে তার মৃত্যু বা কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত এক মাসের মধ্যেও জানতে পারেনি পুলিশ।
১৪ জানুয়ারি দুপুরে শহরের লাল দীঘিরপাড়ে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে তুষার মোল্যা নামে এক রিকসা চালককে। ঘটনার ১৭ দিন পার হলেও কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
১৯ জানুয়ারি রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে মাংস ব্যবসায়ী রিপন হোসেন দিপু নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সহযোগী অপর তিন ব্যবসায়ী। ২০ জানুয়ারি সকালে পরকীয়ার বলি হয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের শাহাদাত হোসেনের ছেলে তৌফিক হোসেন।
এই ব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) বেলাল হোসাইন বলেছেন, যে সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে প্রায় সবগুলোরই সনাক্ত এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনেছে পুলিশ।

 
									 
					