নিজস্ব প্রতিবেদক
সার কিনতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন যশোরের প্রান্তিক কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, চাহিদামতো টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও এসব সার পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। তবে পর্যাপ্ত সার মজুত রয়েছে জানিয়ে কৃষি বিভাগ বলছে, সংকটের নামে কেউ বাড়তি দামে সার বিক্রি করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যশোরে চলতি মৌসুমে এক লাখ ৩২ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। এসব জমিতে কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তুলতে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের ব্যবহার জরুরি। কৃষকের স্বার্থে সরকার ডিলারদের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে এসব সার সরবরাহ করে আসছে।
তবে এবার কৃষকদের অভিযোগ, চাহিদামতো টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার তারা পাচ্ছেন না। সারের দোকানে গেলে প্রায়ই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে-পর্যাপ্ত মজুত নেই। এর পাশাপাশি সংকটের অজুহাত দেখিয়ে প্রতি কেজি টিএসপি সারে ১৬ টাকা এবং ডিএপি ও এমওপি সারে ৬ টাকা করে অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।
নজরুল ইসলাম নামে এক কৃষক বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো সার পাচ্ছি না। দোকানে গেলে দোকানদার বলে সার নেই। তবে ইউরিয়া সার সরকারি দামে মিললেও টিএসপি, ডিএপি আর এমওপি সার প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। প্রতি বিঘায় তিন বস্তা সার লাগে, এত ভর্তুকি দিয়ে চাষ করা সম্ভব না। ফলে জমিতে কম সার দিতে হচ্ছে।’
আব্দুল খালেক নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘আমরা ন্যায্য মূল্যে সার পাচ্ছি না। ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সার বাড়তি দাম না দিলে বিক্রি করছে না ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে টিএসপি সার দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। এভাবে দ্বিগুণ দামে সার কিনে চাষাবাদ করে টিকে থাকা সম্ভব না। সারের দাম যদি না কমানো হয় তাহলে আমাদের মতো গরিব কৃষকদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।‘
নূর হোসেন নামে অপর এক কৃষক বলেন, ‘১৩৫০ টাকা বস্তার ইউরিয়া সার ১৪০০ টাকা, টিএসপি সার ২১৫০ টাকা। সারের দোকানে গেলে বলে সার নেই, তাই দাম বেশি। তাছাড়া প্রয়োজনমতো সার দিচ্ছে না। এখন কি করার আছে? ”
জালাল উদ্দিন নামে এক কৃষক বলেন, ‘আমার ৪০ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ। সরকারি দামে সার পাচ্ছি না। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এখন ৫০ কেজির এক বস্তা ইউরিয়া কিনছি ১৪৮০টাকা, টিএসপি ২১৫০ টাকা, এমওপি সার ১৬৮০ টাকা এবং ডিএপি কিনছি ১৫০০ টাকা দরে। এত বেশি দামে সার কিনে আমরাতো টিকে থাকতে পারবো না। সারের দাম কমলে অনেক সুবিধা হয়।‘
প্রান্তিক সার ব্যবসায়ীদের দাবি, ইউরিয়া সরবরাহ ঠিক থাকলেও অন্য সার চাহিদামতো মিলছে না। তবে সেই সার বাইরে বেশি দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে ননইউরিয়া সার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পলাশ হোসেন নামে এক সার ব্যবসায়ী জানান, ‘সরকার প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি সারের দাম নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা, ডিএপি ২২ টাকা আর এমওপি ২০ টাকা। তবে ইউরিয়া চাহিদামতো পাওয়া গেলেও অন্য সারের সরবরাহ মিলছে না।’
তিনি আরও বলেন, গুদামে গেলে বলা হয় ৫০ ব্যাগ ইউরিয়া নিতে হলে কেবল ৫ বস্তা টিএসপি আর দুই-তিন বস্তা করে ডিএপি ও এমওপি সার দেয়া হবে। অথচ ধান চাষে ইউরিয়ার সমান টিএসপি সার লাগে, কিন্তু সেটা গুদাম থেকে দেয়া হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে বেশি দামে টিএসপি, ডিএপি আর এমওপি কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনে আনার কারণে সেগুলোও আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
হাবিবুর রহমান নামে আরেক সার বিক্রেতা জানান, ‘চাহিদামতো টিএসপি, ডিএপি আর এমওপি সার পাওয়া যাচ্ছে না। গত দুইদিন ধরে ২০ বস্তা টিএসপি সারের জন্য ইউনিয়ন ডিলারের কাছে ধরনা দিয়েছি, কিন্তু একটি বস্তাও সংগ্রহ করতে পারিনি। অথচ এই মুহূর্তে কৃষকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টিএসপি সার। আমরাও চাইলে কৃষকদের দিতে পারছি না। যেসব বিক্রেতা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দামে আমদানি করা সার কিনছেন, তারা বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে তা বিক্রি করছেন। সরকার যদি একটু নজর দিতো, তাহলে অন্তত আমন মৌসুমে কৃষকদের এভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।’
তবে চাহিদার অর্ধেক বরাদ্দ পেলেও কৃষি বিভাগের দাবি সারের কোনো সংকট নেই। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন জানান, ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকেও কোনো ধরনের সার সংকটের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। সংকটের বিষয়টি সত্য নয়। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারকে বিব্রত করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি কেউ অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করলে মাঠপর্যায়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া এবং প্রয়োজনে ডিলারশিপ বাতিল করার নির্দেশনা রয়েছে।’
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় চলতি আমন মৌসুমে বিভিন্ন সারের এক লাখ ৮৪৪ মেট্রিক টন সারের চাহিদা রয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৪৬ হাজার ৮৭০ মেট্রিক টন। আর মজুত আছে ৫ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন।