আবদুল কাদের
যশোর শহরের বারান্দীপাড়া এলাকার আসলাম হোসেন ২০২১ সালে নিজ বাড়িতে ৩শ সোনালী মুরগি নিয়ে একটি ছোট পরিসরে খামার গড়ে তোলেন। কিন্তু মুরগির খাদ্য ও ওষুধের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় লোকসান হতে থাকে তার খামারে। শেষমেষ তিনি খামারটি বন্ধ করে দেন।
কেশবপুরের ভগতি নারেন্দ্রপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনও ৪শ লেয়ার মুরগি নিয়ে খামার গড়ে তোলেন। গেল বছর তিনিও খামারটি বন্ধ করে দেন একই কারণে।
শুধু ওই দু’জন নয়, যশোর জেলায় গত দুই বছরের ব্যবধানে এক হাজার ৫৭৯টি মুরগি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দফায় দফায় খাবারের দাম বেড়ে যাবার কারণে খামারিদের লোকসান দিতে হচ্ছে। আবার এখাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ থাকায় ছোট খামারিরা প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না বলে জানান।
যশোর জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে জেলায় মুরগি খামার ছিল ২ হাজার ৭২৩টি। এরমধ্যে পোল্ট্রি ছিল এক হাজার ৪২৩টি এবং ব্রয়লার ছিল এক হাজার ৩শ। এখন সেখানে টিকে রয়েছে এক হাজার ১৪৪টি।
ঝিকরগাছার মোবারকপুর গ্রামের ওহিদুজ্জামান শাওন জানান, আমার লেয়ার খামারে ৪ হাজার ২শ মুরগি রয়েছে। প্রতিদিন ৩ হাজার ডিম পাওয়া যায়। যা দিয়ে গত ৩ বছর আগেও ভালো ছিলাম। তখন ৭-৮ টাকায় ডিম বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন ১১ টাকা পিস ডিম বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এর কারণে হিসেবে তিনি বলেন, এক বছর আগেও প্রতি বস্তা ফিড ১৬শ টাকা ছিল, এখন সেই বস্তায় হয়েছে ২ হাজার ৭৫০ টাকা। এছাড়া সব ধরণের ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় টিকে থাকা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:মণিরামপুরে যুবককে ছুরিকাঘাত
কেশবুপরের হাসপাতাল সড়কের বাসিন্দা মশিয়ার রহমান জানান, তার খামারে লেয়ার মুরগি রয়েছে ৭ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার ডিম পাওয়া যায়। বছরখানেক আগেও ডিম বিক্রি করে ভালো অবস্থা যাচ্ছিল। বর্তমান সময়ে মুরগির খাবারের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ডিম বিক্রি করেও লাভ করা যাচ্ছে না। সেই সাথে মুরগির সব ধরণের ওষুধের দাম বেড়েছে। এছাড়া পোল্ট্রিখাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান জড়িত থাকায় ছোট খামারিরা টিকতে পারছেনা। কেননা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই ফিড ও ওষুধ তৈরি করে নিজেদের খামারে ব্যবহার করেন। সেই কারণে তারা কম দামে এগুলো পেয়ে থাকে। আর আমাদের মতো খামারিরা সেই খাদ্য বা ওষুধ কিনতে হচ্ছে তাদের থেকে বেশি দামে।
একই উপজেলার খতিয়াখালি গ্রামের শিলা রানী বলেন, তাদের খামারে ৩৫শ মুরগি রয়েছে। খামারে প্রতিদিন ৩২শ ডিম পাওয়া যায়। এই ডিম বাজারে বর্তমানে সাড়ে ১০ টাকা করে বিক্রি করছি। মুরগির খাদ্যের দাম তিনগুণ বেড়েছে, কিন্তু ডিমের দাম পিসে ২ টাকা বেড়েছে। এতে করে ডিম বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না। কোন রকম টিকে থাকতে হচ্ছে। যদি সামনে ভালো সময় আসে এই ভরসায়।
যশোর শহরের পোল্ট্রি ফিড খামাব বিক্রেতা সাব্বির আহমেদ জানান, গত এক বছরের ব্যবধানে মুরগির খাবারের দুই-তিনগুণ দাম বেড়েছে। আগে যেখানে ভুট্রার কেজি ছিল ১৮ টাকা, সেটি এখন ৩৬ টাকা। রাইসপলিস ২৮ টাকা জায়গায় বিক্রি করছি ৩৩ টাকায়। এবং সয়াবিন ছিল ৩৮ টাকা, সেটি এখন ৮৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক ছোট খামারি ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে আমাদের ব্যবসাও ছোট হয়ে আসছে। বাজারে লেয়ার মুরগি বাচ্চা ৪৩ টাকা, ককরেল ১৮ টাকা এবং ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা পিস হিসেবে।
আরও পড়ুন:পাওনা আদায়ে মণিরামপুরে বিএনপি নেতা শহীদ ইকবালের নামে মামলা
জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরের আফিল পোল্ট্রি ফার্ম বৃহৎ পরিসরে ডিম ও একদিনের বাচ্চা উৎপাদন করছে। তাদের ডিমপাড়া মুরগি রয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার। ৩ লাখ মুরগি থেকে মাংস উৎপাদন হয়। আর প্রতিমাসে ডিম উৎপাদন হয়ে থাকে এক কোটি ৩৬ লাখ ৮ হাজার পিস।
আফিল গ্রুপের পরিচালক মাহবুব আলম লাভলু বলেন, আমাদের ফার্ম এই অঞ্চলে পোল্ট্রিখাতে অবদান রেখে চলেছে। প্রতিদিন ৬ লাখ ৭২ হাজার ডিম উৎপাদন হচ্ছে। যা এই অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে অন্যস্থানে পাঠানো হয়।
এব্যাপারে যশোর জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা, রাশেদুল হক জানান, পোল্ট্রিখাতে আমাদের জেলা অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। আমরা নিয়মিত সব খামারিদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। খামারে রোগ হলেই পরামর্শ দিচ্ছি। এতে করে পোল্ট্রিখাত বড় হচ্ছে। তবে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে প্রতিযোগিতায় ছোট খামারিরা টিকতে পারছে না। এতে করে তারা ব্যবসা গুটিতে নিচ্ছেন। খাবারে ভুট্টা লাগে ৫৫ শতাংশ। সেটির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে এক হাজার ৫৭৯টি মুরগি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করেও অনেকে খামার গড়ে তুলছেন।
আরও পড়ুন: পলিথিন-প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে জনমত পাঁয়ে হেটে ভারতীয় যুবক ঝিনাইদহে