সুনীল ঘোষ: এখনো শীতের তীব্রতা বাড়েনি। সন্ধ্যা ও রাতের কিছুটা সময় উত্তরের হিমেল হাওয়ায় নগরজীবনে কিছুটা শীত অনুভূত হচ্ছে। অনেকের ধারণা এবার শীতের তীব্রতা বাড়বে না। কারণ বিশে^র অনেকে দেশে যুদ্ধ চলছে। প্রচুর বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এর প্রভাবমুক্ত না। বেচাবিক্রি নিয়ে যশোর নিক্সন মার্কেট ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
যশোর নিক্সন মার্কেট অতিপরিচিত নাম। এখানে পুরনো হলেও ভালমানের কাপড়-চোপড় কম দামে পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন নিক্সন মার্কেট মানে পুরনো কাপড়-চোপড় বেচাবিক্রির বাজার। দু’দশক আগে ধারণাটি ঠিকই ছিল; কিন্তু নিক্সন মার্কেটেও কয়েকশ’ নতুন তৈরি পোশাকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
তবে পুরনো কাপড় বেচাবিক্রি বন্ধ হয়নি। বিদেশ থেকে বছরে প্রচুর পুরনো কাপড়ের আমদানি হয়। যা যশোরের নিক্সন মার্কেটে পাওয়া যায়। স্থায়ী দোকানিদের পাশাপাশি প্রতিবছর শীত ঘিরে মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও পুরনো পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেন। হকাররাও বছরভর হরেক রকমের তৈরি পোশাক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এবারও ব্যতয় ঘটেনি। শীতের আগমনী বার্তায় ইনস্টিটিউট মাঠ ও মুজিব সড়কের দু’পাশে পুরনো শীতবস্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছেন শতাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী। এখানে শীতবস্ত্রের বাইরেও হরেক রকমের পুরনো পোশাক বিক্রি হয়। উন্নত দেশগুলো থেকে আমদানিকৃত বেল্টে শীতবস্ত্র শোয়েটার, জ্যাকেট ও কম্বলসহ উলের তৈরি নানা ধরণের পোশাক থাকে। এসবের বাইরে কাপড়ের বেল্টে প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, ওড়না, বেল্টে স্যালোয়ার-কামিজ, টুপি, হাত ও পায়ের মোজা এবং ট্রাউজারসহ ছোট-বড় নানা ধরণের পোশাকও আসে।
আশির দশক পর্যন্ত নিক্সন মার্কেট শীতকালেই জমজমাট থাকতো। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কালেক্টরেট সংলগ্ন নিক্সন মার্কেটে গড়ে উঠতে থাকে স্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে দেশি তৈরি পোশাকের বেচাবিক্রি হয় বছরজুড়ে। তবে শীত মৌসুমে নিক্সন মার্কেট পায় নতুন রুপ। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে মুখর হয় বাজার। প্রথম দেখায় বাইরের যেকারোর মনে হতে পারে শুরু হয়েছে কোনো উৎসব।
বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরের পদচারণায় উৎসবমুখর হয়ে ওঠে নিক্সন মার্কেট।
তবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। আরএন রোডের পোশাক বিক্রেতা আবুল হোসেন কালু জানান, হতাশায় আছি। বেল্ট ভেঙ্গে শীতবস্ত্রসহ হরেক রকমের পোশাক নিয়ে বসে আছি। কিন্তু খুব বেশি শীত না থাকায় ক্রেতা নেই।
আবু তাহের নামে এক পোশাক বিক্রেতার কর্মচারী হাসিবুর রহমান জানান, বেচাবিক্রি খুবই খারাপ। বারান্দিপাড়ার পোশাক বিক্রেতা জাকির হুসাইন জানান, সারাদিন যা বেচাবিক্রি করছি তা দিয়ে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতনই উঠছে না। মুস্তাকিন প্যান্ট হাউসের কর্মচারী হাসিব হোসেন বলেন, শীত নেই, তাই ক্রেতাও নেই।
আলমগীর সিদ্দিকী হলের পশ্চিমকোণে গরম বস্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ষষ্ঠীতলাপাড়ার পলাশ কুন্ডু, মনা ও মিঠু নামে ৩ বন্ধু। প্রতিবছর শীত মৌসুমে তারা দোকান নিয়ে বসেন। কিন্তু এবার শীতের তীব্রতা না থাকায় বেচাবিক্রি একেবারেই কম। তারা জানান, লাভের দরকার নেই; এখন চালান উঠলে হয়।
ঝুমঝুমপুরের বাসিন্দা ফারুক হোসেন জানান, এখনো শীত পড়েনি। তাই কিছু কম দামে গরম বস্ত্র কেনার জন্য এসেছি। খুলনা থেকে যশোরে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, যশোর নিক্সন মার্কেটে কম দামে শীতবস্ত্র পাওয়ায় শুনে দোকান ঘুরে দেখছি। কম দামে ভাল জিনিস পেলে কিনবো। তিনি বলেন, খুলনাতেও নিক্সন মার্কেট আছে কিন্তু সেখানে তুলনামূলকভাবে দাম বেশি।
এ সময় নিক্সন মার্কেটের নামকরণ নিয়েও কথা বলেন কামাল। তিনি বলেন, যদ্দুর মনে পড়ে ৭৩ সালের দিকে আমেরিকা কিছু পুরনো কাপড়-চোপড় পাঠিয়েছিল। সেইসব পুরনো কাপড় বেচাবিক্রি হতে দেখেছি। খুলনাতেও নিক্সন মার্কেট আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন আর কিছু জানা নেই।
নিক্সন মার্কেটের দোকানীরাও জানেন না নামকরণের ইতিহাস। তাদের ধারণা-পুরনো কাপড়-চোপড় বিক্রি হয় বলে নাম হয়ে গেছে নিক্সন মার্কেট।
সাংবাদিক ও গবেষক সাজেদ রহমান বকুল বলেন, এর সঠিক কোনো ইতিহাস জানা নেই। তবে আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নামে নামকরণ হয়েছে বলে বিভিন্ন মুখে শোনা যায়।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে লিখেছিলেন-প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে জানাতে চাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দূতাবাস পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। সেই চিঠিতে তিনি অনেক কিছু লেখেন।
তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল, আমরা সম্পূর্ণরুপে বাঙালি জনগণের অগ্রগতি ও কল্যাণের আকাঙ্খাকে সম্মান করি।
সেই চিঠির পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপহার হিসেবে প্রচুর পুরনো কাপড় পাঠান। সেইসব কাপড়ের কিছু অংশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে তহবিল গঠন করে।
বেজপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে পুরনো কাপড়ের প্রথম চালান পাঠায় আমেরিকা। তিনি বলেন, সেইসব পোশাক বা কাপড় বিভিন্ন জেলায় কম দামে বিক্রি হতে দেখেছি। পরবর্তীতে যেইসব বাজার নিক্সন মার্কেট নামে পরিচিতি পেয়েছে।