নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরে একের পর এক বিষাক্ত স্পিরিটপানে (নেশাজাতীয় দ্রব্য) প্রাণ ঝরছে। গত তিন বছরে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মারা গেছেন তিনজন। এরমধ্যে একজনের ময়নাতদন্ত করা হলেও অন্যজনকে নিয়ে গোপনে দাফন করেন স্বজনরা। এরআগে ২০২০ সালের ১৭ জুন ঝিকরগাছার ছয়জন ও একই বছরের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে মারা যায় ১০ জন।
এ সব ঘটনায় তাৎক্ষণিক তোলপাড় হলেও পরে থিতিয়ে যায় প্রশাসনের তৎপরতা। পরবর্তীতে অবৈধ স্পিরিট কেনাবেচা ও ভেজাল মদ তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্টরা অন্ধকারেই রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক হুমায়ন কবির খন্দকার বলেন, আগের মৃত্যুর কারণ বিষয়ে তার কাছে তথ্য নেই। তবে সর্বশেষ তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে। হোমিওপ্যাথিক দোকান থেকে তারা রেকটিফাইড স্পিরিট কিনে তারা পান করেন বলে জানতে পেরেছি। আজ রোববার (২৯ জানুয়ারি) অভিযান চালানো হবে। এজন্য তিনজনের মৃত্যু নিয়ে এরবেশি বলতে চাই না।
তবে অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকানে রেকটিফাইড স্পিরিট বিক্রি করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু যশোরের কোন হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকানের সেই অনুমোদন নেই। এ বিষয়ে সম্প্রতি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিক্রেতা সমিতির নেতৃবৃন্দর সাথে কথা বলেছি। তাদেরকে অনুমোদন নিতে বলা হয়েছে।
যশোর জেলা হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বর্ষা হোমিও হলের সত্ত্বাধিকারী ডা. সামছুল হক। তিনি বলেছেন, হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসিগুলোর রেকটিফাইড স্পিরিট কেনাবেচা করতে পারে না। ওষুধের প্রয়োজনে কোম্পানির কাছ থেকে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ রেকটিফাইড স্পিরিট রাখেন দোকানে।
যশোর জেনারেল হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র মতে, গত ২৫ জানুয়ারি রাতে যশোর সদরের আবাদ কচুয়া গ্রামের একটি বাগানে এই গ্রামের ইসলাম হোসেন, আবুল কাশেম ও জাকির হোসেন এবং সিতারামপুর গ্রামের বাবলু হোসেন ও রিপন হোসেন নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করেন। তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন। অবস্থার অবনতি হলে ইসলামকে গত ২৬ জানুয়ারি তথ্য গোপন করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আরও পড়ুন: দুর্নীতি রোধে জেলা প্রশাসকদের নির্মোহ ভূমিকা প্রয়োজন
বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে তিনি মারা যায়। পরিবারের সদস্যরা দ্রুত ছাড়পত্র ছাড়াই মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়। অন্য চারজনও অসুস্থ হয়ে পড়লে শুক্রবার সকালে তারা একে একে যশোর হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জাকির হোসেন দুপুর পৌনে একটার দিকে মারা যান। এরপরই নেশাজাতীয় দ্রব্য পানের বিষয়টি জানাজানি হয়। ঘটনা জানাজানি হলে বাবলু ও রিপন হোসেনকে হাসপাতাল থেকে বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। আর শুক্রবার রাতে মারা যান আবুল কাশেম।
এরআগে ২০২০ সালের ১৭ জুন যশোরের ঝিকরগাছায় নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়ে রাজাপুর গ্রামের হাবিল গাজী ও নুর ইসলাম খোকা, বর্নি গ্রামের ফারুক হোসেন, হাজিরালী গ্রামের আসমত আলী, পুরন্দরপুর গ্রামের হামিদুর রহমান এবং ঋষিপাড়ার নারায়ণসহ ছয়জন মারা যান।
একই বছরের ২৫ ও ২৬ এপ্রিল নেশাজাতীয় দ্রব্য পানে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে যশোর সদরের শেখহাটি কালীতলা এলাকার শাহিন, যশোর শহরের বেজপাড়ার নান্নু, শহরতলীর ঝুমঝুমপুর মান্দারতলার ফজলুর রহমান, শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের মনিবাবু, ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের সাবু, যশোর শহরের বারান্দী মোল্যাপাড়ার বাসিন্দা মদের দোকানের কর্মচারী আব্দুর রশিদ, চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলার আক্তারুজ্জামান, ঝিকরগাছার কাটাখালি গ্রামের সাহেব আলী, মণিরামপুরের মোহনপুর গ্রামের মোমিন ও মোহনপুরের মুক্তার আলী মারা যায়।
যশোর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আব্দুর রশিদ জানান, গত দুই দিনে মারা যাওয়া তিন ব্যক্তিকে অসুস্থ অবস্থায় স্বজনরা তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। রোগীদের মুখে গন্ধ থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্য পানের গন্ধ বের হলে জানাজানি হয়।
কচুয়া ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দেলোয়ার হোসেন বলেন, মারা যাওয়া জাকির, ইসলাম ও কাশেম তিনজনই তার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তারা রেক্টিফাইড স্পিরিট পানে মারা গেছেন। স্পিরিট পান করে তারা বমি করেছিলেন। তখন গ্রামের মানুষ জানতে পারেন।
কচুয়া ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, ‘তারা একসঙ্গে চলাফেরা ও নেশা করেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নেশাজাতীয় বিষাক্ত স্পিরিট পানে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি।’
আবাদ কচুয়া গ্রামের আকরাম শেখ বলেন, ‘রেক্টিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে বিভিন্ন মাদক মিশিয়ে পান করেছেন তারা। নেশা করে সেদিন বমি করেছিলেন সবাই। প্রথমদিন দুই জন এবং পরদিন আরেকজন মারা গেছেন।’
ওই গ্রামের চা দোকানি আবুবক্কর বলেন, ‘তারা একসঙ্গে চলাফেরা করে। রাতের বেলায় মাদক সেবন করে। দুদিন আগে নেশাজাতীয় বিষাক্ত স্পিরিট পানে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।’
অসুস্থ আশরাফ হোসেনের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেছেন, আমার স্বামী বাজারে কাঠের ব্যবসা করেন। কোনও নেশা করেন না। এগুলো মিথ্যা কথা।
মৃত ইসলামের ভাই লিয়াকত হোসেন বলেন, স্প্রিট পান করেছিলেন বলে আমিও শুনেছি। তবে ইসলাম কিছুটা অসুস্থও ছিল।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, মৃতরা অতিরিক্ত বা বিষাক্ত নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেছিলেন। প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা অন্যকেউ তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। দুইজনের গোপনে দাফন করা হয়েছে। আর কাশেমের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: তিন বছরেও মেলেনি ঝিকরগাছা কপোতাক্ষ সেতু প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা