রেজওয়ান বাপ্পী
ঝিকরগাছার নাভারণ কুন্দিপুরের মেসার্স হীরা ব্রিক্স। ইটভাটাটির পাশেই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে দুটি মসজিদ। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ২০১৭ সালে ইটভাটাটি নির্মাণ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তবে জনবহুল এলাকা থেকে এর কার্যক্রম বন্ধ করতে যশোর জেলা প্রশাসন ও ঝিকরগাছা উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করেন স্থানীয়রা। তবে তা বন্ধ হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বীরদর্পে সেই থেকে ভাটাটি ইট পুড়িয়ে আসছে। এ চিত্র শুধু হীরা ব্রিকসের নয় জেলার ১১৬টি ভাটার চিত্র একই। জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে ১৪৬টি।
স্থানীয়রা জানান, যখন যে দল প্রভাবশালী তখন সেই দলের লোকজন হীরা ব্রিকসের হাল ধরেন। বর্তমানে ভাটাটি পরিচালনা করছেন শার্শা উপজেলার দক্ষিণ বুরুজবাগান গ্রামের বিএনপি নেতা আয়নাল হোসেন।
অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স। কোনো অবৈধ ইটভাটাকে সহ্য করা হবে না।
-এমদাদুল হক, উপপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, যশোর।
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে সংশোধনী এনে ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়। লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান সংযোজন করে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন আইন, ২০১৯’ বিল সংসদে পাস হয়। ধারা-৪ এ সংশোধনী এনে বলা হয়, চলমান যেকোনো আইনে যা কিছুই থাক না কেনো, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত, সেই জেলার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ না করলে কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবেন না। কিন্তু যশোরের প্রেক্ষাপটে এ সবের ব্যত্যয় ঘটে আসছে ২০১৯ সালের সংশোধনীর পরও।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী, এক কিলোমিটারের মধ্যে আবাসিক এলাকা, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, বাগান, জলাভূমি, কৃষি জমি, বিশেষ কোনো স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার বা ১ হাজার মিটার দূরত্বে ভাটা স্থাপন করতে হবে। একই সঙ্গে ভাটাগুলো এখন জিগজ্যাগ পদ্ধতির হতে হবে। ১২০ ফুট চিমনির সনাতনী ভাটা এখন আর আইনসিদ্ধ নয়, কিন্তু যশোর জেলার অধিকাংশ ভাটার ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে চলেছে।
জেলায় এমন ভাটাও রয়েছে, যেখানে এক কিলোমিটার তো দূরের কথা, ২০ গজের মধ্যেই রয়েছে বসতবাড়ি। ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে ঘনবসতি গ্রাম। ভাটা নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো শর্তই মানা হয়নি। আবার সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবেও চলছে কয়েকটি ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, আবাসিক এলাকায় ধানী ও কৃষি জমি নষ্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে ইটভাটা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও মসজিদ, শতাধিক পরিবারের বসতি গ্রামসহ রয়েছে স্পর্শকাতর অনেক প্রতিষ্ঠান। বিগত সময়ে পরিবেশ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভাটা নির্মাণ করা হয়েছে।
তথ্য বলছে, এক কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, জেলায় এমন ভাটার সংখ্যা রয়েছে ১১০টি। এর অনেকগুলো জিগজ্যাগ হলেও পরিবেশ আইন মানা হয়নি। ওই তালিকা থেকে বছর কয়েক আগে ৩৩টি ভাটার ব্যাপারে ঢাকা সদর দপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট শাখায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল যশোর পরিবেশ অধিদপ্তর। আইনগত বৈধতা না থাকায় ওই ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল প্রতিবেদনে। তারপরও ভাটাগুলোর অধিকাংশই এখন চলছে বহাল তবিয়তে।
এ দিকে দূষণে যশোরের বায়ুর গুণমান আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ বায়ুদূষণ মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী বায়ুর গুণমানের সহনশীল মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রামে ২ দশমিক ৫ পিএম হলেও মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) এই মাত্রা ১০৭ দশমিক ৯৮। সোমবার ছিল ১১৮ দশমিক ১৫। যা পরিবেশের জন্য একপ্রকার মারাত্মক হুমকি বলে মনে করছেন সচেতনমহল।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক এমদাদুল হক বলেন, ‘ভাটা-সংক্রান্ত সব অসঙ্গতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মাঠে নামা হচ্ছে। সব ধরনের দেন-দরবার উপেক্ষা করে জনস্বার্থে এবং এলাকার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে অবৈধ সব ভাটা উচ্ছেদে কাজ শুরু হয়েছে। অনেক ভাটার আংশিক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু ভাটা সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। অবৈধ কোনো ইটভাটাকে সহ্য করা হবে না। আমার যেহেতু ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই সেহেতু লিখিত দিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে পর্যায়ক্রমে সব উপজেলার অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এদিকে সারা দেশের সব অবৈধ ইটভাটা চার সপ্তাহের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সকল বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিকে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে আগামী ১৭ মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে অবৈধ ইটভাটা ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় তার ব্যাখ্যা দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৭ মার্চ তাদের সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।