আনন্দঘন মুহূর্তটির প্রতীক্ষায় সংস্কৃতিপ্রেমীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ এই বার্তা নিয়ে নববর্ষ ১৪৩২ কে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে যশোরবাসী। সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত মঙ্গল শোভাযাত্রার আঁতুড়ঘর যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে চলছে প্রস্তুতি পর্ব। লোকজ সংস্কৃতির শক্তিতে, প্রতিবাদী চেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্ন দেখছেন সংস্কৃ তিমনারা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর আরও স্বাড়ম্বরে পালিত হবে নববর্ষ উৎসব, এমনটাই আশা তাদের।
ঈদ আনন্দ শেষ না হতেই কদিন বাদে আসছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব ‘বাংলা বর্ষবরণ’। আনন্দঘন এ মুহূর্তটির জন্য অনেক আগে থেকে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন সংস্কৃতিপ্রেমীরা। সব ধর্মের মানুষ, সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ সমান আগ্রহ নিয়ে উৎসবে যোগ দেন। উদার, অসাম্প্রদায়িক মানবিক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বড় সুযোগ করে দেয় বাংলা নববর্ষ। ১৪৩১ বর্ষ বিদায় থেকে বর্ষবরণে পহেলা বৈশাখে থাকে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা।
১৪৩২ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে যশোরে চলছে রঙ-তুলির আঁচড়ে পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি। এসব আঁচড়ে ফুটে উঠছে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিভিন্ন অনুষঙ্গ। আর এসব অনুষঙ্গের কর্মযজ্ঞ সামলাচ্ছে যশোরের আঁকিয়েদের সংগঠন চারুপীঠ। চারুপীঠের শিল্পীরা কেউ মুখোশ তৈরি করছেন, কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নাচ, গান, নাটকের প্রস্তুতি নিয়ে।
শহরের পৌর পার্কে শুধু চারুপীঠ নয়, এবার যশোরের ৩০টিরও বেশি সংগঠনের কার্যালয়ে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। আয়োজন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী। উদীচী, বিবর্তন, ব্যাঞ্জন যশোর, তির্যক যশোর, পুনশ্চ, চাঁদের হাট, উৎকর্ষ, স্পন্দন, সপ্তসুর, যশোর, সুরধনী, সুরবিতান, নিত্যবিতানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে চলছে গান, নাচ, নাটক ও গীতিনাট্যের মহড়া। বর্ণিল উৎসব ঘিরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তৈরি করেছে ভিন্ন আঙ্গিকের আমন্ত্রণপত্রও। যদিও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উৎসবকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা নেতিবাচক কথা হলেও সেসব কথা আমলে নিচ্ছেন না যশোরের সংস্কৃতি কর্মীরা। বরং সকল শঙ্কা কাটিয়ে উৎসবের আমেজে নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন: ডাক্তার সেজে প্রতারণা, পল্লবী ক্লিনিকের মালিককে এক লক্ষ টাকা জরিমানা
বর্ষবরণকে ঘিরে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তেমনি নিরাপত্তার বিষয়েও সচেষ্ট রয়েছে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাংস্কৃ তিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফায় সভাও করেছেন তারা। ফলে বাঁধভাঙা আনন্দে যশোরে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হবে বলে আশা করছেন সাংস্কৃতিক নেতারা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সভাপতি দীপংকর দাস রতন জানান, করোনার কারণে ১৪২৭ ও ১৪২৮ সনে নববর্ষের উৎসব ছিল ঘরবন্দী। ১৪২৯ ও ১৪৩০ সনে সংক্রমণ কমলেও রমজান মাস হওয়ায় অনেকটা কাটছাঁট করে উৎসবে মেতেছিল যশোরবাসী। ১৪৩১ সনে সন্ধ্যার আগেই শেষ করতে হয়েছে বৈশাখের আয়োজন। এবার সবকিছু স্বাভাবিক থাকায় স্বাড়ম্বরে ঢাকঢোলের বাদ্যে মেতে উঠতে প্রস্তুত হচ্ছে সংগঠনগুলো।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, উৎসব আয়োজনে প্রত্যেক সংগঠন প্রস্তুতি শুরু করেছে। আলাদাভাবে নিজস্ব ব্যানারে অনুষ্ঠান করবে তারা। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে যৌথ কর্মসূচি ঠিক হবে। তিনি জানান, তার নিজস্ব সংগঠন বিবর্তন ও সুরধুনী বরাবরের মতো এবারও নবকিশলয় মাঠে যৌথভাবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করবে।
উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খাঁন বিপ্লব বলেন, বরাবরের মতো পৌর উদ্যানে উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এবার সকালে এবং বিকেলে দুই দফায় সংগঠনটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থ াকবে। দেশের প্রাচীনতম সুরবিতান সঙ্গীত একাডেমি পড়েছে বেকায়দায়। শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল ময়দানের শতাব্দীর বটবৃক্ষ তলে সংগঠনটির বিশাল আয়োজন খাকলেও এবার বাণিজ্য মেলা বাধ সেধেছে। তার মাঝেও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সংগঠনটি। সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. বাসুদেব বিশ্বাস জানান, উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। পহেলা বৈশাখে একাডেমি কার্যালয়ে সকলের জন্য মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা থাকবে।
পুনশ্চর সাধারণ সম্পাদক পান্না লাল দে বলেন, গতবারের ধারাবাহিকতায় এবারও মুসলিম একাডেমি মাঠে এবং ঠিক সকাল ছয়টা ৩১ মিনিট থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। তিনি জানান, চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান আয়োজনে সমস্যা দেখা দিয়েছে এবারের বাণিজ্য মেলা। তবুও শতাব্দী বটবৃক্ষ তলে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। যশোর সাহিত্য পরিষদ নিজ কার্যালয়টি ফিরে পাওয়ায় সকলের মাঝে এখন উন্মাদনা যেন একটু বেশি। বর্ষবরণে কবি সাহিত্যিকদের প্রধান এই সংগঠনটিতে পহেলা বৈশাখে সকাল ১০টায় কবিতা পাঠ, আবৃত্তি আর মিষ্টি মুখের আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দন যশোর ভোর ৬টায় নিউ বেজপাড়াস্থ সংগঠন কার্যালয় প্রাঙ্গণে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করবে।
চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার। তিনি জানান, এক মাস আগে থেকে তাদের শিক্ষার্থী আর শিল্পীরা কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রস্তুতিও চূড়ান্ত।
পৌর উদ্যান, মুসলিম একাডেমি, আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, নবকিশলয় মাঠ এখনও পর্যন্ত নিষ্কণ্টক থাকলেও শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউনহল ময়দান রয়েছে বাণিজ্য মেলার নামে ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে পুনশ্চ’র বর্ষবিদায়, সুরবিতানের বর্ষবরণ আয়োজনে ঘটছে ছন্দপতন। সাধারণ মানুষও শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাত অবধি অনুষ্ঠান উপভোগ থেকে এবার বঞ্চিত হবে।
বর্ষবরণে বিভিন্ন সংগঠনের থাকবে আলাদা আয়োজন। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই মুখ্য। সংগঠনগুলোর কার্যালয়ে মিষ্টি মুখ করানোর পাশাপাশি বরাবরের মতো নান্দনিক আমন্ত্রণপত্রে নিমন্ত্রণ এবং শুভেচ্ছা জানানো হবে। এছাড়াও সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আলাদা পোশাক থাকবে নজরকাড়া। পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতী অনুষ্ঠান করবে জেলার কয়েকটি সংগঠন। এ উপলক্ষে ইতোমধ্যে প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: যশোর শিক্ষা বোর্ডের ২৯৯ কেন্দ্রে পরীক্ষার্থী ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৪ জন