শাহারুল ইসলাম ফারদিন
বাজেটে তামাকজাত পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব পাশ হলে আগামী জুলাই মাস থেকে সিগারেটের দাম বাড়ার কথা। কিন্তু চলতি জুন মাসের শুরুতে ডিলার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ডিলার তার পছন্দের কিছু ব্যবসায়ীর কাছে অগ্রিম টাকা নিয়ে সিগারেট বিক্রি করেছেন বলে দোকানীদের অভিযোগ। যেকারণে দোকানগুলোতে ডিলারের গাড়ি থেকে সিগারেট বিক্রি করা হচ্ছেনা। আবার দিলেও চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না। দোকানীরা শহরের দড়াটানা ও বড় বাজারের ২-৩টি দোকান থেকে বাড়তি দামে এসব সিগারেট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। খুচরা দোকানীদের অভিযোগ প্রতিবছর বাজেট প্রস্তাব করার পর থেকেই অর্থাৎ জুন মাসের শুরুতে ডিলার সিগারেট বিক্রি কমিয়ে দিয়ে মজুত করে থাকেন। শুধুমাত্র তার পছন্দের কিছু বড় ব্যবসায়ীর কাছে মজুত সিগারেট বিক্রি করেন। আর এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
বাজেট পাশ হবার আগেই ডিলারের এই কারসাজিতে পাইকারি এবং খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। প্রতি শলাকায় দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা।
শুক্রবার বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি শলাকা বেনসন সিগারেটে দুই টাকা বেড়ে ১৮ টাকা হয়েছে। আর গোল্ডলিফ এক টাকা বেড়ে ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে যে মালবোরো সিগারেট প্রতি শলাকা ১৬ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বেড়ে ১৮ টাকা হয়েছে। তবে রয়েল, ডার্বি, হলিউড আগের দাম পাঁচ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, চাহিদামতো সিগারেট মিলছে না। সিগারেটের ডেলিভারিও বন্ধ রয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরাসরি কোম্পানি থেকে নেওয়া ডিলার বাজারে সিগারেট ছাড়ছে না।
শহরের এমএম আলী রোডের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, কোম্পানির গাড়ি বা লোক আসছে না। পাইকারি দোকানে গিয়ে বেনসন যে প্যাকেট দুইশত ৮৪ টাকায় কিনতাম, সেই প্যাকেট এখন তিনশত ১০ টাকা ও গোল্ডলিফ আগে ছিলো ২২২ টাকা। যা এখন কিনতে হচ্ছে দুইশত ছত্রিশ টাকার বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। কোম্পানির লোক আসলে হয়তো দাম বাড়ত না।
অপর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, বেনসন প্রতি শলাকা ১৮ টাকা, গোল্ডলিফ ১৩ টাকা করে বিক্রি করছি। যদি কোম্পানি থেকে পাওয়া যায় তাহলে বেনসন ১৭ টাকা পিস বিক্রি করা হচ্চে। আমার জানামতে সিগারেটের তো কোনো সংকট নেই। প্রত্যেক বাজেটে এমন কাজ করে ডিলার ও পাইকাররা মিলে। বাজেট ঘোষণার পরই সিগারেটের প্রতি শলাকার দাম দুই টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুরাতন খয়েরতলা বাজারের ফুড পার্কের স্বত্তাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে যেখানে সপ্তাহে ৩০ কার্টন সিগারেট নিতাম, সেখানে এখন আমাকে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১২ কার্টন। তাও আবার আগের দামের চাইতে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এজন্য খুচরা হিসাবে প্রতি শলাকা বেনসনে ২ টাকা ও গোল্ডলিফে ১ টাকা বেড়েছে। সিনডিকেটকে দায়ী করে এ দোকানি বলেন, কোম্পানি থেকে যে ডিলার সিগারেট নেন, তার একাধিক গোডাউনে মজুত করে রেখেছেন। বাজারে সিগারেট ছাড়ছেন না। সাইফুলসহ একাধিক পাইকারি সিগারেট ব্যবসায়ীর অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবার বাজেটের আগে কোম্পানিগুলো মার্কেটে সংকট তৈরি করে আগে থেকেই দাম বাড়িয়ে দেয়। কোম্পানি, ডিলারসহ যারা সিগারেট মজুদ করে, তাদের লাভ হচ্ছে বেশি। তাদের মধ্যেই পাইকারদের অবস্থান, এতে লাভও খুব অল্প হয়।
দড়াটানা মোড়ের দিলরুবা ট্রেডার্সের মালিক (পাইকারি সিগারেট বিক্রেতা) বলেন, মজুত নেই, তাই সিগারেটের সংকট। এ জন্য দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, গোল্ডলিফ পাইকারি দরে এক বক্স (দশ প্যাকেট) আগে ছিল ২ হাজার ২২০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৬০ টাকা। বেনসন দুইহাজার ৮৪০টাকা ছিলো যা এখন বেড়ে হয়েছে তিন হাজার একশত টাকা।
উজ্জল হোসেন নামে এক ধুমপায়ী জানান, দোকানে প্রতি পিস মালবোরো সিগারেট ১৬ টাকায় বিক্রি হতো, এখন কোনো দোকানে ১৭ টাকা আবার কোনো দোকানে ১৮ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট কিনতে গেলে ৩২০ টাকা দাম চাইছে। বাজেটে প্রতি বছরই সিগারেটের দাম বাড়ে, এটা নতুন কিছু না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হওয়ার আগেই দোকানিরা সিগারেটের দাম বাড়িয়ে দেয়। অনেক দোকানি বাজেটের আগে থেকেই সিগারেট বিক্রিতে অতিরিক্ত লাভের আশায় মজুদ করে রাখছে। বাধ্য হয়ে সবাই সিগারেট বেশি দামে কিনছেন।
অভিযোগের পরও যশোরের বাজারে সিগারেটের সরবরাহ নিয়মিত বলে দাবি করেছেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাক্যোর যশোরের একমাত্র ডিলার মেসার্স আজিজুর রহমান ডিস্ট্রিবিউটরের সেলস ম্যানেজার মাসুদ পারভেজ। পাইকারী ও খুচরা দোকানিদের অভিযোগের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের কথা সঠিক নয়। আমাদের পর্যাপ্ত পণ্য আছে, বরং চাহিদানুযায়ী বিক্রি হচ্ছে না। পণ্য ফেরৎ আসছে। বাজেটের আগেই দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, সকল কাগজপত্র আছে আমাদের। বাংলাদেশে সরকারি শুল্ক সবচেয়ে বেশি দিয়ে থাকে আমাদের কোম্পানি। তারা এমন কিছু করবেনা যে তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় উঠতে হয়। ডিলার আজিজুর রহমান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (পহেলা জুন) জাতীয় সংসদে বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের সব কটির মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। সিগারেটে কর বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাড়তি ছয় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছেন। সিগারেটের মূল্যস্তর চারটি। নিম্ন স্তরে মূল্য ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা, মধ্যম স্তরে ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭, উচ্চ স্তরে ১১১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৩ এবং অতি উচ্চ স্তরে ১৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক ১ শতাংশ বাড়বে শুধু নিম্ন স্তরে। এতে নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম বেশি বাড়তে পারে।