জাহিদুল কবীর মিল্টন
যশোরে স্বজনদের হাতে একের পর এক স্বজন খুনের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের চার মাসে স্বজনদের হাতে স্বজন খুনের একাধিক ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ শনিবার অভয়নগর উপজেলায় ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছে ভাই। এর আগে শহরের রেলরোড চারখাম্বা মোড় ফুডগোডাউন এলাকায় ভাইয়ের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোন খুন হয়। এছাড়া শহরতলীর শেখহাটিতে ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে ভাই খুন হয়। এরআগে স্ত্রীর পরকীয়ায় আপন ভাইপোর সহযোগিতায় আলমনগর গ্রামের আব্দুর রউফের ছেলে দুবাই প্রবাসি সোহেল রানাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২৮ এপ্রিল রাত ১১ টার দিকে অভয়নগর উপজেলার জাফরপুর ঘোড়া বটতলায় আইনাল হোসেনের সেজো পুত্র ইমরান হোসেন তার বড় ভাই ইসমাইল হোসেনকে পরিবারের সদস্যদের সামনে গলাটিপে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। নিহত ইসমাইল হোসেন যশোর এমএসটিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, ওই দিন রাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়ার একপর্যায়ে ছোট ভাই ইমরান হোসেন গলাটিপে বড় ভাইকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
২৫ এপ্রিল রাতে শহরের রেলরোড চারখাম্বা মোড়ে আপন ছোট ভাই ফায়াজ রাজ্জাক ফারদিনের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহানা পারভিন উর্মি খুন হয়। ফায়াজ রাজ্জাক ফারদিনও আমেরিকান বিশ^বিদ্যালয়ের এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। চারখাম্বা মোড়ের ইমরান কবিরের বাড়িতে ছেলে ফায়াজ রাজ্জাক ফারদিন ও মেয়ে ফারহানা পারভিন উর্মিকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মা আইরিন বেগম। ঘটনার রাতে পারিবারিক বিষয় নিয়ে ফায়াজ রাজ্জাক ফারদিনের সাথে বড় বোন ফারহানা পারভিন উর্মির কথাকাটাকাটি হয়। উর্মিকে ধাক্কা দিলে খাট উপর পড়ে গেলে মাথায় আঘাত পায়। এ সময় ওরনা গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে শ^াসরোধ করে উর্মিকে হত্যা করে ভাই ফারদিন। উর্মির মৃত্যুর পর মা আইরিন বেগম ও ছেলে ফারদিন ওই রাতে উর্মির লাশ গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীহট্র গ্রামে নিয়ে যায় দাফন করতে। সেখানে স্বজনদের বলা হয় উর্মি আত্মহত্যা করেছে। উর্মি মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় অনেকে বিশ্বাস করে। গোসলের সময় উর্মিও মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়ায় নিহতের চাচা রবিউল ইসলাম পুলিশে খবর দিলে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করে। একই সময় ফারদিন ও তার মা আইরন বেগমকে হেফাজতে নেয়। জিজ্ঞাসাবাদে ফারদিন ও আইরিন বেগম উর্মি হত্যার কথা স্বীকার করে। এ ঘটনায় রবিউল ইসলাম ওই দুইজনকে আসামি করে মামলা করে।
৩১ মার্চ রাতে শহরতলীর শেখহাটিতে পারিবারিক বিষয় নিয়ে আপন ছোট ভাই ইউসুফের ছুরিকাঘাতে বড়ভাই ইউনুস আলী খুন হয়। এদিন সকালে ইউসুফ আলী প্রতিবেশি গোপাল কুমার পালের বাড়ি যেয়ে তার মা গৌরি রানি পালের সাথে অশোভন আচরণ করে। একপর্যায়ে গৌরি রানি পালকে মারপিটসহ তার ছেলেকে খুনজখমের হুমকি প্রদান করে। গৌরি রানি পালের চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে গেলে ইউসুফ ভয়ভীতি প্রদান করে চলে যায়। এ বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ইউসুফ ক্ষিপ্ত হয়ে বড়ভাই ইউনুসের বুকে ছুরিকাঘাত করে। স্থানীয়রা ইউনুসকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
১২ এপ্রিল যশোরের মঠবাড়িয়া গ্রামের বুকভরা বাওড় এলাকায় স্ত্রীর পরকীয়ার জের ধরে দুবাই প্রবাসী সোহেল রানাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের আপন ভাইপো জিয়াদুল হক জিসান এতে সহযোগিতা করেন।
জানা যায়, সোহেল রানা ওই দিন ইফতারের পর মোটর সাইকেল যোগে আলম নগর গ্রামে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে আনতে। মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলেন আপন ভাইপো জিয়াদুল হক জিসান। মঠবাড়িয়া গ্রামের বুকভরা বাওড় ভেড়ির জনৈক মাস্টার আব্দুল জলিল গংয়ের ধানী জমির পশ্চিম পাশে পাকা রাস্তার উপর পৌছুলে স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক আলম নগর খালপাড়া গ্রামের ফজলু হোসেনের ছেলে ফারাব্বি হোসেনসহ অজ্ঞাত পরিচয় আসামিরা মোটর সাইকেলের গতিরোধ করে। আগে থেকেই ভাইপো জিসানের সাথে ফারাব্বিসহ অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসীদের গোপন যোগাযোগ ছিলো। এরপর ধারালো গাছি দা দিয়ে কুপিয়ে সোহেল রানাকে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে রাস্তায় ফেলে যায়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় সোহেল রানাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় নিহত সোহেল রানার ছোট ভাই হালসা বিশ্বাসপাড়া গ্রামের আব্দুর রউফের ছেলে শাকিল খান ১৪ এপ্রিল তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত নামা ১/২ জনকে আসামি করে কোতয়ালি থানায় মামলা করেন। পুলিশ সোহেল রানা হত্যা মামলার তিন আসামিকেই গ্রেফতার করে।
গত বছর ২৯ আগস্ট বিকালে যশোর শহরের আশ্রম মোড়ের (রেলরোড) খুন হন রওশন আরা বেগম রোশনী (৫৩) নামে এক নারী। ছোট বোনের ছেলে হৃদয় খালার বাড়ির স্বর্ণালঙ্কারের লোভে বন্ধুকে নিয়ে খুন করে লাশ খাটের নিটে লুকিয়ে রাখে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ ঘটনায় জড়িত ভিকটিমের বোনের ছেলে রিয়াজুল আলম চৌধুরী হৃদয় ও তার বন্ধু মো. বুরহানকে গ্রেফতার করে।
স্বজনদের হাতে অব্যাহতভাবে স্বজনখুন নিয়ে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই বলছে যশোর পুলিশ। এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) জুয়েল ইমরান দৈনিক কল্যাণকে বলেন, এটা আইনশৃংখলা পরিস্থিতির সাথে খুব একটা যায় না। এটা সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সামাজিক অবক্ষয় দূর করার দায়িত্ব সকল মানুষের। এ গুলো একদিনে তৈরি হয়নি। সমাজ ব্যবস্থা থেকে ক্রমে ক্রমে তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন রকম অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করে নাগরিকদের সচেতন করে এ সব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন দৈনিক কল্যাণকে বলেন, সামাজিকীকরণের আসল জায়গা হলো পরিবার। সেই জায়গা থেকেই মানুষজন সামাজিকতা শিখবে এবং ছোট কাল থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনটা সৃষ্টি হবে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে সম্মান; স্নেহ এখন লাভক্ষতির পরিমাণের অংকে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের মাঝে সেই বন্ধনটা আর হচ্ছে না। ফলে আবেগী সম্পর্কের সেই ভিত্তিটা থাকছে না। সামাজিকীকরণের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে বলেই এধরেণের ঘটনা বারবার ঘটছে।
তিনি আরো জানান, এসব হত্যাকাণ্ড সংগঠত হয় হতাশাগ্রস্তরা বেশি করে থাকে। এটা দ্রুত কোন সমাধান হবে না। তাই দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরো সমাজব্যবস্থাকে আমাদের মূলবোধকে জাগ্রত করতে হলে ছোটকাল থেকেই এসব জায়গা থেকে নজর দিতে হবে। মাদক নির্মূল করতে হবে। সকলপ্রকার আশক্ত থেকে যুবসমাজকে বের করে আনতে হবে।