জাহিদ হাসান
৭৫ সদস্য বিশিষ্ট যশোর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। উপদেষ্টা পরিষদ আরও ১৯ জনের। কিন্তু দলীয় কর্মসূচিতে চার ভাগের একভাগও উপস্থিত হয় না। বেশির ভাগ নেতা অনুপস্থিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক। এমনকি তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়ার দাবিও জানান। সম্প্রতি যশোর আওয়ামী লীগের একটি কর্মসূচি প্রকাশ্যে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে বীরমুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলামকে সভাপতি ও শাহীন চাকলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ২২ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্মেলনের প্রায় দু’বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন দেওয়া ১৯ উপদেষ্টাসহ ৯৪ সদস্যের এই কমিটিতে তরুণ ও সাবেক ছাত্রনেতারা স্থান করে নেন। যশোরের রাজনীতিতে অচেনা অনেকেও ঠাঁই পায়। পূর্ণাঙ্গ কমিটির দুই বছর হতে চলেছে। কিন্তু মাত্র এই দুই বছরে অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। যারা পদ নিতে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দিনরাত ধর্না দিতেন তারাও সভা-সমাবেশে অংশ নেন না।
জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, ‘গত শুক্রবার দলের ৭৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাসহ ৯৪ জন সদস্য বহরের মধ্যে সভাপতি-সম্পাদকসহ ১২ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে, শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসে সভাপতিসহ ১০ জন, ৬ দফা দিবসে সভাপতিসহ ৯ জন, বঙ্গবন্ধুর জুল ও কুরি পদকের সভাতে ১৩ জন, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যবর্তন দিবসে সভাপতি-সম্পাদকসহ ১৭ জন, মুজিবনগর দিবসে সভাপতিসহ ১০ জন, ২৬ মার্চ কর্মসূচিতে ৯ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে ১৪ জন, ৭ মার্চ ১৩ জন।
কমিটি গঠনের চার বছরের মধ্যে যশোর আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় সমাবেশ করে গত ২৮ জুন (প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জনসভা বাদে)। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজশাহী বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ হত্যার হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে ও বিচার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশে দলটি জেলার ৮ উপজেলার নেতাকর্মীরা অংশ নিলেও সেখানেও জেলার ২০ থেকে ২৫ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন ৭ জন সহসভাপতি, দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, দুইজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদধারীরা। এছাড়া ১৯ উপদেষ্টা ও ৩৫ জন সদস্যের মধ্যে হাতে গোনা ৫-৬ জন অংশ নেন। বাকী ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় যে নেতারা রয়েছেন তারাও গ্রুপিংয়ের কারণে প্রতিটি প্রোগ্রামে অংশ নেন না। বিএনপি যখন ‘সরকার হটাতে দেশে-বিদেশে তৎপর’ তখন জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরে বসে থাকা নিয়ে কর্মীদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক সহ সভাপতি বলেন, ‘দলের ভিতরে কোন শৃঙ্খলা নাই। দলের যে সাংগঠনিক কার্যক্রম সেটা সভাপতি-সম্পাদকের মধ্যে নাই। দল গঠনের পরে কোন সাংগঠনিক সভা হয়নি। সকল সিদ্ধান্ত সভাপতি সম্পাদক নেয়। ৫টি উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি দীর্ঘদিনেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কয়েকটি কমিটি মেয়াদ উর্ত্তীণ। যশোর সদর, মণিরামপুর, ঝিকরগাছা, অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটিতে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। কতিপয় নেতার একক আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহারে বেড়েছে গ্রুপিং। তৃণমূল ঢেলে সাজাতে না পারায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হচ্ছে সংগঠন। ফলে ক্ষোভে অভিমানে দলের সভা সমাবেশে যাওয়া হয় না।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা একে এম খয়রত হোসেন বলেন, ‘দলের কোন শৃঙ্খলা নাই। সিনিয়রদের মূল্যায়ন করা হয় না। দলের ত্যাগীদের বাদ দিয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতার কর্তৃত্ব বেশি। দলে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বলয় সৃষ্টি করতে যে যার মতো কমিটি বানিয়েছে। অন্যদের মূল্যায়ন করে না। তাই দলের সভা সমাবেশে যাওয়া হয় না।
জেলা সদস্য ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, ‘দলের যখন কমিটি দেওয়া হয়েছিলো তখন যোগ্যতা অনুযায়ী কমিটিতে মূল্যায়ন করা হয়নি। অনেক ত্যাগীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। দলে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। ফলে সাবেক ও বর্তমান নেতারা ক্ষোভে সক্রিয় হচ্ছে না। এমনকি যারা যশোরে থাকে না; ঢাকা বা অন্যত্র জেলাতে থাকে এমন নেতাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। যদি ত্যাগী ও যোগ্যদের স্থান দেওয়া হতো তাহলে দলের এই অবস্থা থাকতো না।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। দলের নেতাকর্মীরা অনেক আরাম আয়েশে রয়েছে তাই দলের কর্মসূচিতে আসে না। কমিটি যখন হয় তখন এসব নিষ্ক্রিয় নেতারা সেন্ট্রালে যেয়ে কমিটিতে তদবির করে ঢুকে পড়ে। কমিটি হওয়ার পরে তাদের আর খোঁজে পাওয়া যায় না। তবে এসব নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে চিঠি দেওয়া হবে। যারা দলের কর্মসূচিতে আসে না; তাদের পদ পদবি না দেওয়ায় উচিত। এতে দলের ক্ষতি হয়। তিনি দলে কোন্দল নেই দাবি করে বলেন, বড় সংগঠন আওয়ামী লীগে মতপার্থক্য থাকলেও নির্বাচনে সবাই এক হয়ে যাবে।