চারু আদিত্য: যশোর সদরের ইউপি নির্বাচনে ভোট রাজনীতির নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের ভারে বেশির ভাগ ইউনিয়নে ডুবতে যাচ্ছে নৌকা, এমন আশংকা ভোটবোদ্ধাদের। অধিকাংশ ইউনিয়নে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন আওয়ামী রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রার্থী। দলীয় কোন্দলে নৌকার বিপক্ষে ভোটে নেমেছেন তারা। ফলে নির্বাচনী কাজে দলের নেতা-কর্মীদের পাশে না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন নৌকার মাঝিরা।
অভিযোগ উঠেছে, দলীয় প্রতীক নৌকার এমন বিরোধীতার কারণে পরাজিত হতে যাচ্ছেন দল মনোনীত প্রার্থীরা। আর এই অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে। ‘রক্ষকই আজ ভক্ষক’ ফেসবুকে এমন শিরোনামের স্ট্যাটাস দিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নৌকা মার্কার পরাজয়ের জন্য তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছেন। নৌকার পক্ষে না থেকে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার পাশাপাশি সদর উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
স্ট্যাটাসে এমনও বলা হয়েছে, তারা প্রত্যেকটি ইউনিয়নে নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে নৌকার সমর্থকদের বিশ্বাস ও আস্থা নষ্ট করেছে। আওয়ামী পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দেয়া নৌকার ভরাডুবির জন্য প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন তারা। অতীতে পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য গোপনে নৌকার বিরুদ্ধে তারা কাজ করতেন।
যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ আব্দুল্লাহ আল মাস্উদ হিমেল ও আহসানুল করিম রহমান ফেসবুকে এমন স্ট্যাটস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি শাহীন চাকলাদার, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ ও সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহামুদ হাসান বিপুর ছবিও দেয়া হয়েছে। স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তাদের বহিষ্কারের দাবিও জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক কল্যাণ দপ্তরের টেলিফোন থেকে এ ব্যাপারে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথে বক্তব্য জানতে চাইলে বলেন, আমি এখনও নৌকা প্রতীকের একটি নির্বাচনী জনসভায় রয়েছি। মাইকের শব্দে হয়ত বুঝতে পারছেন নৌকার পক্ষে এখানে সমাবেশ চলছে। ফেসবুকের স্ট্যাটাস মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
যশোর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহামুদ হাসান বিপু বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নৌকার বিপক্ষে অবস্থানের কোন প্রশ্নই ওঠে না।
তিনি বলেন, আমি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। আর ভোট হচ্ছে সদর উপজেলার ইউনিয়নের। তারপরও দল মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা যখনই আমাকে নির্বাচনী কাজে তাদের সহযোগিতার জন্য ডাকছেন তাদের পাশে থাকছি। রামনগরে এখনও নৌকার প্রচারণার কাজে রয়েছি।
ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক যশোর জেলা ছাত্রলীগের দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ আব্দুল্লাহ আল মাস্উদ হিমেল বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা। সদরের ১৫টি ইউনিয়নে যারা নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দিয়েছেন তাদের পদত্যাগ দাবি করেছি। স্ট্যাটাসে সবকিছু পরিষ্কারভাবে বলা আছে।
একদশকেরও বেশি সময় ধরে যশোর জেলা আওয়ামী লীগে তুমুল গ্রুপ পলিটিক্স চলছে। দ্বন্দ্ব মারামারি-হানাহানি ও খুনোখুনি পর্যন্তও গড়িয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার এটি নিত্যদিনের। সদর উপজেলার ইউপি নির্বাচনে একপক্ষের পাল্লায় বেশি মনোনয়ন ও অন্য পক্ষে কম; এটি দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি ঢেলেছে। নিজের গ্রুপের বাইরে যারা মনোনয়ন পেয়েছে তাদের দেখে নেয়ার রাজনীতি চলছে। এক্ষেত্রে বিপক্ষতা চলছে সরাসরি নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে। নিজ দলের প্রতীক ডোবাতে উভয় পক্ষের কেউ পেছন পা হচ্ছেন না। বিরোধীতা দোষারোপ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েও গরম করা হচ্ছে ভোটের বাজার।
যশোর সদরের আসন্ন ইউপি নির্বাচনে অনেক বড় পদধারীরা মনোনয়ন দৌঁড় ছিটকে পড়েছেন। গতবারের মাঝির কাছ থেকে এ যাত্রায় নৌকা কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে নতুন মুখ। এতে দলীয় কোন্দল একপক্ষের জয় অপর পক্ষের হয়েছে পরাজয়। আর তার জের ধরে ১৫ ইউনিয়নে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক। নৌকা হারাতে অনেক ইউনিয়নে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ উভয় গ্রুপের বিপক্ষে।
নরেন্দ্রপুরে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন মোদাচ্ছের আলী। এখানে নৌকার বিদ্রোহী হিসেবে ভোটের মাঠের রয়েছেন রাজু আহমেদ, জাকির হোসেন ও হোসেইন মোহাম্মদ ফেরদৌস আলম। রামনগরে নৌকার প্রার্থী নাজনীন নাহারের বিপক্ষে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন মাহামুদ হাসান লাইফ।
কচুয়ায় নৌকার প্রার্থী লুৎফর রহমান ধাপক দলের দুই বিদ্রোহীর মুখোমুখি হয়েছেন। এখানে নৌকা বিদ্রোহী নেমেছেন শেখ মাহামুদ হোসেন, আব্দুর রশিদ ও কাজী হাফিজুর রহমান রতœ। উপশহরে নৌকার প্রার্থী এহসানুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে ভোট নেমেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন রতœ। আবরপুরে নৌকার প্রার্থী আরশাদ আলী রহমান বিরুদ্ধে দলের ৬ জন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নেমেছেন। এখানে নৌকার বিদ্রোহীরা প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন-কাজী কাশেম, শামসুর রহমান, নূরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও গাজী রফিকুল ইসলাম। চাঁচড়ায় নৌকার প্রার্থী সেলিম রেজা পান্নুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন শামীম রেজা। হৈবতপুরে নৌকার প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দলের অপর জন প্রার্থী হয়েছেন। তাদের একজন হরেন কুমার বিশ্বাস ও সিদ্দিকুর রহমান। ইছালিতে নৌকার প্রার্থী ফেরদৌসী ইয়াসমিনের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিদ্রোহী হিসেবে মাঠেন আছেন আইয়ুব হোসনে। নওয়াপাড়া ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন মাহাবুবুর রহমান, হুমায়ুন কবীর তুহিন ও কাজী আলমগীর হোসেন। চুড়ামনকাটিতে নৌকার প্রার্থী দাউদ হোসেন দফাদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় রয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মান্নান মুন্না, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, শ্রমিক লীগ নেতা বাদশাহ ও প্রজন্ম লীগ নেতা আলমগীন কবির মিলন। ফতেপুরে নৌকার প্রার্থী শেখ সোহরাব হোসেন বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ফাতেমা আনোয়ার ও আলমগীর হোসেন। দেয়াড়ায় নৌকার প্রার্থী লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক আহবায়ক ও বর্তমান চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান, মাসুদ রানা ও জিয়াউল হক।