- ঘুষের টাকা ভাগাভাগি করে নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
- দালালদের জন্য ‘বরাদ্দ’ ৬ নং কাউন্টার
- প্রতি পাসপোর্টে অফিস খরচ ১১শ, পুলিশ নেয় ৫০০ টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করা হয়। দিন শেষে সেই টাকা সপ্তাহ শেষে জমা দিয়ে যান দালালরা। পুরো সপ্তাহের ঘুষের টাকা এক জায়গায় রেখে প্রতি সোমবার ভাগাভাগি করে নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের ফটকে সেবা প্রার্থীদের প্রবেশ করার সময় বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু দালালদের মনোনীত ব্যক্তিরা কোনো রকম বাধা ছাড়াই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পান। অফিস সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকায় বিকাল ৫ টার আগে কোনো দালাল অফিসে প্রবেশ করে না।
যশোরের শার্শা থেকে আসা সেবাপ্রার্থী আল আমিন বলেন, দালাল ছাড়া কাজ করলে ভোগান্তির শেষ নেই। একই অভিযোগ মণিরামপুর থেকে আসা মামুন নামের এক সেবাপ্রার্থীরও। তিনি আরও বলেন, ‘দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে এসে আমি যেন ভুল করেছি। যারা নিজ উদ্যোগে পাসপোর্ট করতে যান কর্মকর্তারা ভুল ধরার কাজে ব্যস্ত থাকেন। দালালের মাধ্যমে গেলে এমন হয় না। আমার স্ত্রী ও আমার পাসপোর্ট একই দিনে ডেলিভারির তারিখ হওয়ায় জানতে চাই, আমার স্ত্রীকেও আসতে হবে নাকি? ডেস্ক থেকে জানায়, একজন এলেই হবে। অথচ ডেলিভারি নিতে এসে দেখি, আমার স্ত্রীকে ছাড়া পাসপোর্ট নেওয়া যাবে না। আমাকে হয়রানি করতেই এমন করা হয়েছে।
পাসপোর্ট অনিয়ম শুরু যেভাবে :
দালাল ছাড়া কেউ পাসপোর্ট করতে গেলে তার বিপদের শেষ নেই। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এই ভুল’, ‘সেই ভুল’ ধরে হয়রানি করেন। যার কোন ভুল নেই তাকে অন্তত হয়রানির জন্য পাঠানো হয় দুই তলায় এনআইডি যাচাইয়ের জন্য। সকালে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেয়ার সুযোগ পেলে তাকে হয়রানি করতে এনআইডি যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর ফের আবার লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিলে তাকে ফিঙ্গারিং শেষে বাড়ি ফিরতে বিকাল। কিন্তু দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন দিলে কোন ঝামেলা নেই। চটপট সব কাজ হয়ে যাবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। আর দালাল ছাড়া আবেদনপত্র পড়ে থাকে অনেকটা অনাদরে। পুলিশ রিপোর্টেও পাঠানো হয় দেরি করে। পাসপোর্ট পেতেও দেরি হয়।
দালালদের জন্য ‘বরাদ্দ’ ৬ নং কাউন্টার :
নিচতলায় দুটি কাউন্টারে পাসপোর্ট আবেদন জমা নেওয়া হয়। এ দুটো হলো ৫ ও ৬ নং কাউন্টার। ৫ নং কাউন্টার মহিলা, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও বীরমুক্তিযোদ্ধারা জমা দিয়ে থাকেন। সেখানে কিছুটা ভিড়ও কম। আর ৬ নং কাউন্টারে জমা দেয়া হয় দালালদের মাধ্যমে করা পাসপোর্টের আবেদন। বাইরে থেকে আবেদনকারীকে বলে দেয়া হয় কোন চিন্তা নেই। তুমি ৬ নং কাউন্টারে জমা দিবা। তোমার কোন ঝামেলা নেই। স্যার আবেদন দেখলেই বুঝতে পারবেন। কারণ সেখানে সিল ও স্বাক্ষর দেয়া থাকে।
এদিকে, নিজে নিজে যারা পাসপোর্ট করতে যান তারাও এ লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু তাদেরটায় কোন সংকেত না থাকায় সেই ভোগান্তি জুটে যায় কপালে। তাদের এই ভুল, সেই ভুল নানা জেরা। এছাড়া এনআইডি যাচাই করে নিয়ে আসার জন্য দ্বিতীয় তলায় পাঠানো হয়। আর যারা দালালের মাধ্যমে করেন তাদের কোন ভুল নেই। থাকলেও সংশোধন করে দেন কাউন্টারে জমা নেয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। চলতি সপ্তাহে তিনদিন পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে এ তথ্য মিলেছে। তাদের পাসপোর্ট আটকে যেতে পারে এভয়ে তারা নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন।
বাড়তি টাকা ভাগাভাগি :
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে যায় ১০ বছর মেয়াদী পাসপোর্ট করতে এখন সরকার নির্ধারিত ফি ৫ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু দালালের মাধ্যমে করতে দেয়া লাগে ৮ হাজার। বাড়তি টাকার মধ্যে পাসপোর্ট অফিসে চলে যায় ১১শ টাকা। ক্ষেত্র বিশেষ পুলিশের জন্য ৫০০ টাকা, অনলাইনে ফরম পূরণ বাবদ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আর দালালের ৫০০ টাকা।
সোমবার যেন ঈদের দিন :
পাসপোর্ট অফিসে দালালি করেন অন্তত ৩০-৪০ জন। এরা কেউ সরাসরি কেউ ভায়া হয়ে কাজ করেন। প্রতি পাসপোর্টের জন্য তারা অফিসে দেন ১১শ টাকা। সপ্তাহের সোমবার সেই টাকা ভাগাভাগি হয়। পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন ১৯০ থেকে ২০০ টা আবেদন জমা পড়ে। যার ৮০ ভাগই দালালের মাধ্যমে। প্রতিদিন ১০০টিও যদি দালালের মাধ্যমে জমা পড়ে তাও পাসপোর্ট অফিসের দৈনিক অবৈধ আয় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। সপ্তাহের ৫দিনে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
দালাল যারা :
পাসপোর্ট অফিসে অন্তত ৩০-৪০ জন দালালি করেন। এরমধ্যে এমএসটিপি স্কুলের পাশে সোহেল, প্রধান পোস্ট অফিস মোড়ের বিশ^াস কম্পিউটারের সত্ত্বাধিকারী, পাসপোর্ট অফিসের সামনে নিপু, রেলরোডের ইমরুল হাসান মিরাজ, বেজপাড়া এলাকার সেলিম রেজা, চাঁচড়া এলাকার সামাদ, ডিসি কোর্ট চত্বরের বাবু, ডিসি কোর্ট চত্বরের স্ট্যাম্প ভান্ডার আকরামুল অন্যতম। যদিও আগের মতো তাদের প্রতিদিন পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয় না। সপ্তাহে একদিন যেয়ে তারা হিসেব করে টাকা দিয়ে আসেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল বলেন, ‘অফিসে সিসি ক্যামেরা থাকায় এখন আগের সিস্টেমে কাজ করা হয় না। নতুন সিস্টেমে কাজ করতে হয়। বাইরে গেট থেকে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাগজপত্র দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেই। স্বাক্ষর দেখলে অফিসের কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন। কোন অসুবিধা করেন না।
পুলিশের ভেরিফিকেশন বাণিজ্য :
পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে প্রতি আবেদনে পুলিশ পায় ৫০০ টাকা। কোন কোন পুলিশ অবশ্য টাকা নেন না বলেও সুখ্যাতি আছে। তবে দালালদের মাধ্যমে করা পাসপোর্টে ছাড় নেই। সূত্র মতে, পুলিশের এসআই আশরাফ, এএসআই সুরঞ্জন অধিকারী, এএসআই আব্দুল মান্নান, এসআই ইউসুফ, এএসআই রাজু ও কামরুল টাকা ছাড়া কাজ করেন না। এদিকে কোন কোন সাংবাদিকও পাসপোর্ট অফিস থেকে টাকা পান বলে সূত্র দাবি করেছেন।
জানতে চাইলে যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মাকসুদুর রহমান অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করে বলেন, আমি নতুন এসেছি। অনিয়মের বিষয়টি জানা নেই। কোন অভিযোগ পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবো।