তবিবর রহমান: ‘নানা রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’ এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য ও সম্ভাবনার প্রতীক খেজুরের গুড় এবং ফুলকে যশোরের ব্র্যান্ডিং হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ব্র্যান্ডিং এই দুই পণ্য ঘিরে চাষিদের ক্ষোভের অন্ত নেই। পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ অনেক কারণে হতাশ ফুল ও গুড় উৎপাদনে জড়িতরা। তাদের ভাষ্য, সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এ দুটি পণ্যের ভাল দাম পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে বিদেশে বাজার সৃষ্টি করা গেলে এই দুটি পণ্য হতে পারে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের আর এক সম্ভাবনাময় খাত।
কৃষি বিভাগের মতে, ১৯৮৩ সালে যশোরে গদখালীতে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে শার্শা, ঝিকরগাছা ও মণিরামপুর এলাকায়। চাষ হচ্ছে রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা, লিলিয়াম, গাঁদা, জবা ও জুঁইসহ হরেক রকমের ফুল। বর্তমানে দেড় হাজারেরও বেশি হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। এই ফুল যশোরের একটি ব্র্যান্ডিং।
যশোর জেলা ব্রান্ডিংয়ের আরেক পণ্যের নাম খেজুরের গুড়। শীতের সন্ধ্যায় গাছিরা গাছ চেঁচে ভাড় বেধে ভোর বেলা রস সংগ্রহ করেন সেই প্রাচীন কাল থেকেই। সীমাহীন কষ্ট করে রস সংগ্রহের পর গুড় পাটালি তৈরি করলেও দাম নিয়ে তাদের ক্ষোভের শেষ নেই। যে দাম পায় তাতে শ্রমের মূল্যই হয় না। তাই গুড় ও পাটালি দেশের বাইরে পাঠাতে পারলে বেশি দাম পাওয়া সম্ভব হতো বলে মনে করছেন এ জেলার গাছিরা।
ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, এক সময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিপণ্য ছিল খেজুরের গুড়। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউস চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এই চিনি সামান্য লালচে। কিন্তু বর্তমানে আখের চিনির মত ঝরঝরে ছিল। এক সময় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ছাড়াও চিনি রফতানি হত ইউরোপে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি বাণিজ্যকভাবে খেজুর গুড় উৎপাদন করা হয় তাহলে অতীতের মতো বিদেশে বাজারজাত করা সম্ভব। এজন্য দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
সেই কথাই বলেছেন ভেজালমুক্ত গুড় উৎপাদক যশোরের চৌগাছার সঞ্চাডাঙ্গা গ্রামের মাঠপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি ১২০ টি খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছি। এ থেকে উৎপাদিত গুড় ২০০ টাকা কেজি ও পাটালি ৩০০ টাকা বিক্রি করি। এই গুড় উৎপাদনে যে শ্রম সেই অনুযায়ী আরো দাম হওয়া উচিত। যদি গুড় পাটালি বিদেশ পাঠানো যায় তবে নিশ্চিত বেশি দাম পাবেন তারা।
একই গ্রামের আরেক চাষি আবুল কাশেম বলেন, আমাদের নামে ভেজাল গুড় উৎপাদনের অপবাদ করা হয়। কিন্তু ন্যায্য দাম নিয়ে কেউ কথা বলেন না।
পানিসারা গ্রামের ফুল চাষি ইসলাইল হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফুল নিয়ে বিপাকে পড়েন এ অঞ্চলের ফুল চাষিরা। যদি ফুল রফতানি করা যায় চাষিরা উপকৃত হবেন। যশোরে রয়েছে নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমান বন্দর। সরকার উদ্যোগ নিলে ফুল সহজেই বিদেশ পাঠানো সম্ভব।
বাংলাদেশ ফুল চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ফুল সম্ভাবনাময় সেক্টর। এটা বিদেশ রফতানির সুযোগ রয়েছে। কিছু কিছু ফুল আছে যেগুলোর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সেই ফুলগুলো রপ্তানির জন্য আমরা দীর্ঘদিন দাবি করে আসছি। আগে ফুল উৎপাদনের পর ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সুবিধা ছিল না। বর্তমানে ঢাকাসহ অন্য ৬ জেলায় ফুলের মার্কেট হয়েছে। যশোরের পানিসারায় ফুল প্রসেসিং সেন্টার হয়েছে। ফলে ফুল রফতানি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, গুড় ও ফুলের মান বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, চাষি পর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের জ্ঞানের অভাব, বিপণন ব্যবস্থার সহায়ক অবকাঠামো এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের মত কিছু সমস্যা বিদ্যমান। এ সব সমস্যা কাটিয়ে ভালোমানের ফুল ও ভেজালমুক্ত গুড় উৎপাদন করতে হবে। আর সেগুলো বিদেশ রফতানি করতে পারলে চাষিরা উচ্চ মূল্য পাবেন।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, বিদেশে ফুলের কতটা চাহিদা রয়েছে সেটা খোঁজ নিতে হবে। আর দেশেই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভেজালমুক্ত পাটালি ও গুড়ের। সেক্ষত্রে ভেজালমুক্ত পাটালি ও গুড় উৎপাদন দরকার। ব্র্যান্ডিং দুই পণ্যের জন্য অবশ্যই বিদেশে বাজার খোঁজা যেতে পারে। বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে পারলে নিশ্চয়ই চাষিরা উপকৃত হবেন। আমরা এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবো।