জাহিদ হাসান
যশোর মেডিকেল কলেজে সম্প্রতি বেড়েছে বহিরাগতদের আনাগোনা। এতে যেমন শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে; তেমনি ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে দুই হাত ও পা ভেঙ্গে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহিরাগত কিছু যুবক ও অপর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। এরপর থেকে কলেজফটকে বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে হকিস্টিক দিয়ে পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তা প্রহরীরা। এদিকে হকিস্টিক দিয়ে পাহারা থাকলেও স্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে শিক্ষার্থীদের মনে ভর করেছে উদ্বেগ। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
রোববার ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই সাধারণ পোশাকে কয়েকজন যুবককে দেখা গেল হাতে হকিস্টিক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। মহড়ার মতো করে ওই নিরাপত্তা কর্মীদের প্রথম দেখাতেই বিষয়টি নিয়ে ভীতকর পরিস্থিতি মধ্যে পড়বে যে কেউ। প্রথম দেখাতেই ভীতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাহসান হাবিব, নাজমুল সাকিবের মতো অনেক শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, ক্যাম্পাসে দিনরাত বহিরাগতদের আনাগোনা অনেকদিন ধরেই। যা কিছুদিন আগে ছাত্রাবাসে বহিরাগত, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মধ্যে মারামারি ঘটনা ঘটেছে। বহিরাগতদের ঠেকাতে প্রশাসন হকিস্টিক দিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। যা দেখে যে কেউ ভয় পাবেন। আমরাও প্রথমে পেয়েছিলাম। আগে এমন ছিলো না। কিছুদিন হলো ক্যাম্পাসে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দিনের পর দিন বহিরাগতদের ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত মিঠুন কুমার দাস বলেন, ‘হকিস্টিক দেখে যে কেউ ভয় পাবে স্বাভাবিক। কলেজ প্রশাসন আমাদের ছয়জনকে দিয়েছে। গত স্বরস্বতী পূজায় বহিরাগতের সঙ্গে ঝামেলা আর সর্বশেষ ছাত্রাবাসে মারামারি ঘটনায় কলেজ প্রশাসন নিরাপত্তার কারণে এটি আমাদের দিয়েছেন। তবে ক্যাম্পাস-ছাত্রাবাসে বহিরাগতদের অবাধ যাওয়া আসার কথা স্বীকার করলেও মাদক সেবনের কথা স্বীকার করেননি তিনি। নাম না প্রকাশে কয়েক শিক্ষার্থী বলেন, বিকাল ও সন্ধ্যার পরে বহিরাগতদের প্রবেশ বেশি দেখা যায়। বিকেলে শিক্ষকরা না থাকায় আর কলেজটা শহরের একটু বাইরে হওয়ায় এই সময়ে সুযোগটা বেশি নিচ্ছে তারা। এছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরে বখাটে ছেলেদের আড্ডা আরো ভীতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। বহিরাগতদের প্রবেশে তারা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এছাড়া কয়েকটি ঘটনায় ক্যাম্পাসে আরো এই ভীতকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটছে। দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মহিদুর রহমান বলেন, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অবাধ চলাচল কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গেল স্বরস্বতী পূজায় বহিরাগতরা আমাদের এক স্টাফকে মারধর করে ও হাত কেটে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলো। তার পর থেকে অনেক নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করতে চায়ছিলো না। তাই বহিরাগতদের ঠেকাতে ও তাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের হাতেই হকিস্টিক দিয়েছি। অনেকেই পড়াশোনা শেষ হলেও ছাত্রাবাসে রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের নামিয়ে দিতে পারি না। ছাত্রাবাসে মারামারির ঘটনায় তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই বিষয়ে অনেকটাই চাপে থাকে কলেজ প্রশাসন।

কলেজের ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখে বহিরাগত নিয়ে নানা অভিযোগ আর অনুযোগ শোনা গেছে। বহিরাগত দিন দিন বড় এক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতেও পারছে না। এই বলতে না পারার কারণও রাজনৈতিক। অনেকেই পড়াশোনা শেষ হলেও ছাত্রাবাসে রয়েছে। সেই পড়াশোনা শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাস ও ছাত্রবাসে বহিরাগতরা আসার সুযোগ পাচ্ছে। এতে ক্যাম্পাস-ছাত্রাবাসে মাদকসেবন, চুরিরমতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের নামিয়ে দিতে পারি না কলেজ প্রশাসন। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন কলেজের প্রশাসন। গত মঙ্গলবার রাতে ইন্টার্ন চিকিৎসকের দুটি পক্ষের মধ্যে ছাত্রাবাসে প্রভাব বিস্তার ও মাদক সেবন নিয়ে পুর্বশত্রুতার জেরে মারামারি ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় জাকির হোসেন নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক গুরুতর অবস্থায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। দুটি পা-হাত ভাঙ্গা এই শিক্ষার্থী জানান, মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক মেহেদী হাসান লিয়নসহ তিন-চারজন বহিরাগতরা মিলে ছাত্রাবাসের ১০৪ নম্বর কক্ষে প্রতিনিয়ত মাদকের আড্ডা বসান। সারা রাত চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। ওই রুমের পাশেই আমার রুম। এ কারণে পড়াশোনায় ব্যাঘাত হয়। প্রতিবাদ করলে তারা রুমে ঢুকে হকিস্টিক ও জিআই পাইপ দিয়ে আমাকে মারধর করেন। একপর্যায়ে ঘর থেকে নগদ টাকা, মানিব্যাগ ও মোটরসাইকেল নিয়ে যায় তারা। তিনি জানান, মেডিকেল কলেজে মাদক সেবন হয় সেটা সকল স্টুডেন্ট-শিক্ষকরা জানে। স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে প্রশাসন কিছু করতে পারছে না। অপর একটি সূত্র জানায়, হামলাকারীরা অধিকাংশই ইন্টার্ন চিকিৎসক। তাদের লেখাপড়া শেষ হয়েছে দুই বছর আগেই। তারপরও ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় তারা ছাত্রবাসে সিট নিয়ে থাকছে। একই সাথে হামলার শিকার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে অসামাজিক কাজে জড়িত এমন চক্রের সঙ্গে চলাফেরার অভিযোগও রয়েছে। এদিকে, দেশের ভবিষ্যত চিকিৎসকেরা ছাত্রাবাসে মাদক সংশ্লিষ্ট নিয়ে মারামারি ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে অভিভাবক মহলে। বিষয়টি নিয়েও খোদ শিক্ষার্থীরাও লজ্জিত। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে ছাত্রাবাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার আমরা হতবাক লজ্জিত হয়েছি। ঘটনার জন্য শুধু যশোর মেডিকেল না; ডাক্তারদের সম্মানহানি হয়েছে।
এদিকে মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় কলেজ প্রশাসন সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নুর কুতুউল আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামি মঙ্গলবারের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত রির্পোট জমা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘মারামারি ঘটনায় তদন্ত চলছে। মাদক ও বহিরাগতদের বিষয়ে কলেজ প্রশাসন কোন সহযোগিতা চাইলে পুলিশ ব্যবস্থা নিবে।