নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর মেডিকেল কলেজে ‘অপ্রয়োজনীয়’ সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ও জেনারেটর ক্রয়ের নামে বিভিন্ন সময়ে লুটপাট হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্য বিভাগের অডিটে এ বিষয়গুলো ধরা পড়ে। যে কারণে তিন বছর আগে অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ ডা. গিয়াস উদ্দিন এখনো ছাড়পত্র পাননি। তারপরে অবসরে যাওয়া ডা. আখতারুজ্জামানের ছাড়পত্র আটকে যায়। যদিও তিনি সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছেন। আর লুটপাটের মূল স্তরে থাকা হিসাবরক্ষক জয়নাল অবসরে গেছেন সপ্তাহ খানেক হলো। যদিও তিনি এখনো অফিস করছেন। কিন্তু তার বিষয়টি কি হবে সেটা নিয়ে চলছে কলেজে কানাঘুষা। কলেজের এই কানাঘুষ ক্যাম্পাসের বাইরেও ছড়িয়েছে। নিয়মিত আলোচনা চলছে ক্যাম্পাসের বাইরে একটি চায়ের দোকানেও। অন্যদিকে আরেক অভিযুক্ত ‘বড় বাবু’ আব্দুস সবুরের বিরুদ্ধেও এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মেডিকেল কলেজের হিসাব শাখা মতে, তিন বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, আসবাব ও গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা হয়েছে। এর মধ্যে দুই কোটি ৫৭ লাখ টাকার চিকিৎসাসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, ৯০ লাখ টাকার বই ও দেড় কোটি টাকার আসবাব কেনা হয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কলেজে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৮০ লাখ বরাদ্দ দেয়া হয়। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কলেজে লাশ সংরক্ষণের জন্য ২২ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে ‘মরচুয়ারি ক্যাবিনেট’ যন্ত্র। লাশকাটা ঘর (মর্গ) না থাকায় একসঙ্গে চারটি লাশ সংরক্ষণ সুবিধার যন্ত্রটি তিন বছর ধরে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে হাসপাতালের নিচতলায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজের একাডেমিক ভবনের নিচতলায় অ্যানাটমি বিভাগের একটি ছোট কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্র রাখা। শুধু এই মরচুয়ারি যন্ত্র নয়, ‘অপ্রয়োজনীয়’ সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ও একাধিক জেনারেটর কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। টাকা লুটপাট করতে এসব যন্ত্র ও আসবাবপত্র আগেভাগে কেনাকাটা করা হয়েছে।
একাধিক সূত্র মতে, মেডিকেল কলেজে কেনাকাটার নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। নিজস্ব ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশনের ভিত্তিতে কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্য বিভাগের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। কেনাকানার তথ্য চেয়ে কলেজ অধ্যক্ষ বরাবর পত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দুদককে এখনো তথ্য সরবরাহ করেনি কলেজ প্রশাসন।
স্বাস্থ্য বিভাগের নিরীক্ষা দলের তদন্তে বলা হয়, যন্ত্রপাতি, আসবাব ও গ্রন্থাগারে বইপত্র কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। অধ্যক্ষ, হিসাবরক্ষক জয়নাল, উচ্চমান সহকারী আবদুস সবুর কোটি কোটি টাকা লুটপাটের সাথে জড়িত। যে কারণে অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দীন ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন ও আখতারুজ্জামান ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে একই বছরের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। তারা অবসরে গেলেও তাদের ছাড়পত্র আটকে যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করে শনিবার দুপুরে টেলিফোনে বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মহিদুর রহমান বলেন, তবে সম্প্রতি আখতারুজ্জামান ছাড়পত্র পেয়েছেন।
এদিকে চলতি মাসেই অবসরে গেছেন হিসাবরক্ষক জয়নাল। অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে মেডিকেল কলেজে। অবসরে গিয়েও তিনি কিভাবে অফিস করছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ডা. মহিদুর রহমান বলেন, নতুন হিসাব রক্ষক এখনো আসেনি। তাই দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া পর্যন্ত তিনি অফিস করছেন।
দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় অধ্যক্ষের ছাড়পত্র আটকে গেছে। অভিযোগ রয়েছে হিসাব রক্ষক জয়নাল’র বিরুদ্ধেও। তাহলে তার ছাড়পত্র আটকে দেয়া হবে কিনা বা তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি অধ্যক্ষ। তবে কলেজের কেনাকাটার তথ্য চেয়ে দুদক থেকে পত্র দেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, চিঠির উত্তর প্রস্তুত চলছে।
এদিকে, ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বাবলু কিশোর বিশ্বাস বলেন, লাশের ময়নাতদন্ত করার জন্য কলেজে কোনো মর্গ স্থাপন করা হয়নি। মর্গ স্থাপনের আগেই লাশ সংরক্ষণের জন্য মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্র কেনা হয়েছে। যন্ত্রটি রাখার জন্য ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে জায়গাও নেই। যে কারণে অ্যানাটমি বিভাগের কাছ থেকে একটি ঘর ধার নিয়ে যন্ত্রটি রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্রে চারটি চেম্বার রয়েছে। যেখানে একই সঙ্গে চারটি মরদেহ সংরক্ষণ করা যায়। তিন বছর ধরে যন্ত্রটি ওই ঘরে রাখা আছে। ফেলে রাখলে যন্ত্র নষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক।
অধ্যক্ষ মহিদুর রহমান বলেন, আমার আগের অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত গিয়াস উদ্দীনের সময়ে যন্ত্রটি কেনা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চালু করার চেষ্টা করছি। কক্ষের বাইরের দিকে একটি দরজা ও র্যাম্প সিঁড়ি নির্মাণ করে দিলেই যন্ত্রটি চালু করা যাবে।

 
									 
					