নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের চেয়ারে কে বসতে যাচ্ছেন; শহর-গ্রামে সেই বিশ্লেষণ এখন তুঙ্গে। নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটে এগিয়ে রাখলেও সাধারণ ভোটার ও রাজনীতি সচেতনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের কারও ভাষ্য, প্রার্থীরা সবাই একই দলের। তাই আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যার বলয়ের পাল্লা ভারী হবে তিনিই হবেন চেয়ারম্যান। আবার কেউ বলছেন, বিএনপি সমর্থিত ভোটাররা যাকে বেছে নিবেন তার গলায় উঠবে বিজয়ের মালা। তবে একমাত্র নারী প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। তাকে এমপি সমর্থিত ও জেলা আ.লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছেন।
৫ জুন যশোর সদর উপজেলা নির্বাচন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন ৮জন। এরমধ্যে এমপি কাজী নাবিল আহমেদ’র সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীকের আনোয়ার হোসেন বিপুল। আর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক গ্রুপের সমর্থন নিয়ে মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছেন তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী ভোট করছেন আনারস প্রতীক নিয়ে। শালিক প্রতীকে ভোট করছেন যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ এবং জোড়া ফুল প্রতীকে সমর্থন পেতে ছুটছেন সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। কাপ পিরিচ প্রতীক নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম জুয়েল। এছাড়া ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নিরলস ছুটছেন একমাত্র নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার। আর ভোটের মাঠে নামমাত্র আছেন হেলিকপ্টার প্রতীকের আরিফুল ইসলাম হীরা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ৮ জন প্রার্থী হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন তিন থেকে চারজন। কারও কারও জামানতও বাজেয়াপ্ত হতে পারে। যদিও জয়ের ব্যাপারে সব প্রার্থীই আশাবাদী। সেক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন রাজনীতিতে অনেকটা অপরিচিত মুখ ফাতেমা আনোয়ার। জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগের অনেক নেতাকে তিনি তার ঘোড়ায় উঠিয়েছেন।
এদিকে, গত কয়েকদিন ধরে সদরের ১৫টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও পৌরসভার কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দৈনিক কল্যাণ ভোটারদের মতামত নিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে বেশি কিছু তথ্য। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই-তিন ভাগে বিভক্ত। অনেকে নাবিল গ্রুপ, অনেকে চাকলাদার গ্রুপ, কেউ মোহিত নাথ, কেউ শাহারুল গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। তারা নিজ বলয়ের প্রার্থীদের ভোট করছেন। এসব গ্রুপ থেকে বের হয়ে অনেক নেতাকর্মী ফাতেমা আনোয়ারের ঘোড়ায় উঠেছেন। কয়েকজন অবশ্য মোস্তফা ফরিদ আহমেদ এবং শফিকুল ইসলাম জুয়েলের সাথে নির্বাচন করছেন।
সরেজমিনে রামনগর ইউনিয়নে দেখা গেছে, এই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান লাইফ ও যুবলীগ নেতা আলাউদ্দিন মুকুল কর্মী সমর্থকদের নিয়ে ভোট করছেন দোয়াত কলম প্রতীকে। সাবেক চেয়ারম্যান নাজনীন নাহার আলমগীর এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান হাসু নির্বাচন করছেন মোটরসাইকেল প্রতীকে। আর বিশিষ্ট আইনজীবী আকরাম হোসেন, ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মিন্টু ও আরেক আহ্বায়ক উঠেছেন ঘোড়ায়। ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কবির হোসেন ভোট করছেন ফরিদের আনারসে।
জানতে চাইলে রামনগর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছি। আশা করি বিজয়ী হবো।
বসুন্দিয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানেও নিজ নিজ বলয়ের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট করছেন নেতাকর্মীরা। ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম খান রাসেল, ইউনিয়ন আ.লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওহেদুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ভোট করছেন ফন্টু চাকলাদারের মোটরসাইকেল প্রতীকে। ফাতেমা আনোয়ারের ঘোড়া প্রতীকে ভোট করছেন ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মহিবুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি তুহিন খান নির্বাচন করছেন ফরিদ চৌধুরীর আনারস প্রতীকে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান স্বপন ও ইউপি সদস্য ইমরান হোসেন ভোট চাইছেন শাহারুল ইসলামের জোড়া ফুল মার্কায়। তবে অন্য প্রার্থীদের সাথেও ভোটাররা।
এদিকে, নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ভোট করছেন আনোয়ার হোসেন বিপুলের দোয়াত কলম মার্কায়। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের ভোট করছেন মোটরসাইকেল প্রতীকে। আর এখানকার শ্রমিকদের একটি অংশ ভোট করছেন ফাতেমা আনোয়ারের ঘোড়া মার্কায়।
চাঁচড়া ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান, সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচন করছেন মোটরসাইকেল প্রতীকে। আর জেলা শ্রমিক লীগ নেতা সেলিম রেজা পান্নু আছেন দোয়াত কলম প্রতীকের সাথে।
এদিকে সদরের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনিয়নে ভালো অবস্থানে আছে দোয়াত কলম, ঘোড়া ও মোটরসাইকেল প্রতীকের। চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভোট করছেন বিপুলের দোয়াত কলম প্রতীকে। আর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না ও ছাত্রলীগের একাংশ আছেন মোটরসাইকেলের সাথে। এখানে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর তরফদারের নেতৃত্বে ঘোড়া প্রতীকের নির্বাচন করা হচ্ছে।
পাশের দুই ইউনিয়ন হৈবতপুর ও কাশিমপুরের চেয়ারম্যান আছেন বিপুলের দোয়ত কলমের সাথে। আর এই দুই ইউনিয়নের সাবেক দুই চেয়ারম্যান আছেন মোটরসাইকেলের সাথে। আছেন আওয়ামী লীগ-যুবলীগের একাংশও। এছাড়া দেয়াড়ার চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান ও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী ভোট করছেন ফন্টু চাকলাদারের মোটরসাইকেল প্রতীকে। আর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেউ বিপুল ও কেউ ফরিদের নির্বাচন করছেন। পাশে আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম নিজেই এবার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার অবস্থা ভালো বলে মনে করছেন রাজনীতি সচেতনরা। তবে অন্য প্রার্থীরাও ভোট টানবেন বলে কয়েকজন ইউপি মেম্বার জানিয়েছেন।
অন্যদিকে উপশহর ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে নির্বাচন করছেন। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একাংশ দোয়াত কলম, আওয়ামী লীগ নেতা সুখেন মজুমদার ও যুবলীগের মুনসুর আহমেদ বলয়ের নেতাকর্মীরা ঘোড়া এবং আরেক অংশের নেতাকর্মীরা ভোট করছেন মোটরসাইকেল প্রতীকে। লেবুতলার চেয়ারম্যান আলিমুজ্জামান মিলন ভোট করছেন বিপুলের দোয়াত কলমে। এখানকার একাংশের নেতারা ভোট করছেন মোটরসাইকেল প্রতীকে। আর সাবেক চেয়ারম্যান রেজার নেতৃত্বে ঘোড়া মার্কার সাথে আছেন যুবলীগ নেতা বেল্টুসহ ৫ ইউপি মেম্বার। নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছেন মোটরসাইকেলের সাথে। তবে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিভক্ত হয়ে একাধিক প্রার্থীর পক্ষে মাঠে আছেন।
অপরদিকে ফতেপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন ঘোড়া প্রতীকের ফাতেমা আনোয়ার। এটা তার নিজ এলাকা এবং শ্রমিক জোন হিসেবে পরিচিত। এখানকার শ্রমিকরা কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এছাড়া বিভিন্ন সময় তাদের দেখভালোও করেন। তাই এখানে তিনি বেশ ভোটে এগিয়ে থাকবেন বলে ভোটাররা জানিয়েছেন।
যশোর পৌর এলাকায়ও ভালো অবস্থানে রয়েছেন ঘোড়া প্রতীকের ফাতেমা আনোয়ার। পৌর এলাকার ৯ জন কাউন্সিলরের ৩ জন (জাহিদ হোসেন মিলন, সাইদুর রহমান রিপন এবং রাজিবুল আলম) তার সাথে দিনরাত ভোট করে চলেছেন। এছাড়া মনিহার, নীলগঞ্জ এলাকায় তার অবস্থা দৃশ্যমান ভালো রয়েছে। তবে পৌর এলাকায় সবাই কম বেশি ভোট পাবেন বলে ভোটাররা জানিয়েছেন। অন্য কাউন্সিলরদের মধ্যে ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী আলমগীর কবির সুমন আছেন ফন্টু চালকলাদারের সাথে। তিনি দিনরাত মোটরসাইকেলের ভোট চাইছেন। অন্য ২-৩ জন কাউন্সিলরের সমর্থন রয়েছেন দোয়াত কলমের সাথে। একজন আছেন মোহিত কুমার নাথের সাথে। তবে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নাছিমা আক্তার জলি আছেন তার ভাই শফিকুল ইসলাম জুয়েলের সাথে। তারও দিনরাত ছুটছেন ভোটারদের কাছে।
যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক অশোক বোস জানান, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগের বহু নেতা প্রকাশ্যে ফাতেমা আনোয়ারের ঘোড়া প্রতীকের ভোট করছেন। আমরা উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের কাছে পৌছে ভোট চাইছি। ফাতেমা আনোয়ার নারী হওয়ায় নারীদের ব্যাপক সাড়া মিলছে।
আনোয়ার হোসেন বিপুলের দোয়াত কলম প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট এসএম আফজাল হোসেন বলেছেন, তারা বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাদের কোন ইউনিয়নে ঘোড়া প্রতীক, কোন ইউনিয়নে মোটরসাইকেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট জেলা আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন পরে কথা বলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, আমরা কোন প্রার্থীকে হালকাভাবে দেখছি না। তবে ঘোড়া অথবা দোয়াত কলমের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।