শাহারুল ইসলাম ফারদিন
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের করোনারি ও প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রতিদিনই ফরমাল টাইযুক্ত শার্ট প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে একদল লোক। দেখে মনে হবে হাসপাতালের চিকিৎসকরা হয়ত দাঁড়িয়ে কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু পরক্ষণেই জানা যাবে প্রকৃত তথ্য। চিকিৎসকের রুম থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে বের হওয়ায় রোগী দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। রোগীর প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি করে ছবি তুলতে দেখা যাবে তাদের। তাদের পরিচয় ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। বিপদগ্রস্ত রোগীরা তাদের হাতে নাজেহাল হচ্ছে। নিত্যচিত্রের এই তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছেছে বহুবার। কিন্তু সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে জরুরি বিভাগ, বহিঃবিভাগ ও করোনারি কেয়ারের ভিতরে এবং সামনে অবস্থান করছিলেন তিন থেকে চারশত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। শুধু মঙ্গলবার নয় হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র একই। সকালে হাসপাতালের বহিঃবিভাগে রোগীদের তিল ধরার ঠাঁই থাকে না। অসুস্থ রোগীদের জন্য বসার ব্যবস্থা থাকলেও সেসব চেয়ারে ব্যাগ রেখে দেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্কয়ার, ইনসেপ্টা, অফসোনিন, একমি, এসকেএফ, রেসকোসহ বেশ কিছু কোম্পানির এক একজনের ৪/৫ জন বিক্রয় প্রতিনিধি সকাল থেকে অবস্থান নেন হাসপাতাল চত্বরে। তাদের কাজ কোন রোগী চিকিৎসকের রুম থেকে বের হলে মোবাইল ফোনে চিকিৎসাপত্রের ছবি তোলা। বিশেষ করে করোনারি কেয়ারের বহিঃবিভাগে বেশকিছু ডাক্তারের চেম্বারে আনাগোনা বেশি। হাসপাতালের ১, ৪, ৬, ৭ ও ১২ নম্বর রুম, ৩ নম্বর এবং প্রশাসনিক ভবনের অর্থপেডিক্স, শিশু, গাইনি ও ১২৫ ফার্মিসির সামনেসহ বেশ কিছু ডাক্তারের রুমে ও রুমের দরজায় ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের অবস্থান দেখা যায়। অনেকে আবার রোগীদের বলে দেন কোন ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে সেটাও।
হাসপাতালের বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শহরতলীর রামনগর পুকুরকুলের বাসিন্দা পাপিয়া সুলতানা জানান, অসুস্থ মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম গত শনিবার। ওইদিন চিকিৎসাপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় একদল লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাপত্রের ছবি তোলেন। পরে জানতে পারলাম তারা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। গতকাল ও আজ আসলাম তাও একই চিত্র। ভয় পাওয়ার মতো একটা পরিবেশ। দিতে না চাইলে এক প্রকার জোর করেই চিকিৎসাপত্র ছিনিয়ে নেন তারা। শধু পাপিয়া নন এমন অভিযোগ শহরের পুরাতন কসবা এলাকার আজিবর রহমান, সদরের ফতেপুরের তাসনিয়া আফরোজা, মণিরামপুর মাছনা গ্রামের বৃদ্ধা কৃষ্ণ দাসসহ বেশ কয়েকজনের। তারা বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের এমন কার্যকলাপ আসলেই অনেক সময় বিরক্তিকর লাগে। এছাড়াও অনেক চিকিৎসক রোগী না দেখে তাদের সাথে গল্পে মশগুল থাকে। কিছু বললে তারা রাগ করেন। মাঝেমধ্যে ঝামেলাও হয়। গত শনিবার এমন একটি ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের মেডিসিন চিকিৎসক ফারজানা রহমান উর্মির কাছে চিকিৎসাপত্র নিতে যান যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র জিয়াউল হক। তার সাথে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে তিনিসহ বেশ কয়েকজন আরএমও বরাবর লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হয়।
হাসপাতালের আরএমও পার্থ প্রতিম চক্রবর্ত্তী বলেন, নিয়মানুযায়ী সপ্তাহে দুদিন নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসকদের সাথে দেখা করতে পারবেন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তারা নিয়ম অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল একশনে যাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, হাসপাতালের করোনারি কেয়ারের সামনে ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি অবস্থান করছিলেন। পরিচয় জানতে চাইলে তাদের একজন নিজেকে ইনসেপ্টা কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন। নিজের নাম বলেন মিজানুর রহমান। কেন তিনি চিকিৎসাপত্রের ছবি তুলছিলেন জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়ে দ্রুত সিটকে পড়েন।
একই সময় হাসপাতালের নিচতলায় বহিঃবিভাগের গেটের সামনে অবস্থান করছিলেন হরেন দাস নামে অপর একজন। তিনি বলেন, কয়েকটি কোম্পানির হয়ে তিনি কাজ করেন। মূলত কোম্পানিগুলোর তথ্য সংগ্রহ করাই তার কাজ।
ওষুধ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নিয়ে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলছিলেন এক ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি নাম জানতে চাইলে পরিচয় দেন মাজেদুর রহমান বলে। তিনি জানান, কারও সমস্যা সৃষ্টি করছেন না। শুধু ছবি তুলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রিপ্রেজেনটেটিভ জানান, আমরা এভাবে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভোগান্তিতে ফেলতে চাই না। তবে, চিকিৎসক আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখল কিনা সেটা ছবি তুলে না পাঠালে প্রতি মাসিক মিটিংয়ে জবাবদিহি করতে হয়।
হাসপাতালটির ব্যবস্থপনা কমিটির সদস্য এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতাল থেকে বারবার তাড়িয়ে দিলেও তারা আবার অন্যপাশ দিয়ে প্রবেশ করেন। কোনভাবেই তাদেরকে ঠেকানো সম্ভব হচ্ছেনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশীদ জানান, অফিস চলাকালীন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতালে আসা অবৈধ। এটি তারা করতে পারেন না। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে তাদের সমিতিকে অবহিত করা হয়েছে। নিষেধ করলে কয়েকদিন তারা বিরত থাকেন। কয়েকদিন পর আবার যা তাই। এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।