শাহারুল ইসলাম ফারদিন
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের খাবারের মান নিয়ে বহু আগে থেইে রয়েছে অভিযোগ। মাছ ও মাংস দেওয়ার নিয়ম থাকলেও রোগীরা খুঁজে পেতেন না। আর ডাল ও সবজিতে তো মুখে দিতেই পারতেন না রোগীরা। সম্প্রতি রোগীদের অভিযোগ পেয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হারুণ অর রশিদ গোপনে তদারকি করে নিম্নমানের খাবার সরবরাহের সত্যতা পেয়েছেন। এই ঘটনায় একজন কর্মচারীকে সতর্ক ও একজনকে অভ্যন্তরীণ বদলি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে টেন্ডার নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলায় টানা ১০ বছর একজন ঠিকাদার খাবার সরবরাহ করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরেই একই ঠিকাদারের কাছে জিম্মি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগীরা। সেই সাথে রোগীদের রান্নার চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, মশলা আত্মসাতের ঘটনায় হাসপাতালের দুই কর্মচারীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র। হাসপাতালের রোগীদের তিনবেলা খাবারের (পথ্য) জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ১০৯ টাকা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বলছেন, গত রোববার থেকে হাসপাতালের রোগীদের খাবারের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। আমরা নিয়মিত তদারকি করবো। খাবারের মানের সাথে কোন আপস করা হবে না।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের খাবার সরবরাহের দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই সময় ঠিকাদার মো. শফিকুর রহমান হাসপাতালের নির্ধারিত ২৫০ শয্যা এবং করোনারি কেয়ার ইউনিটের ২৮৭ জন রোগীর খাবার সরবরাহের কার্যাদেশ পান। এ সময় টেন্ডারে ত্রুটির অভিযোগ তুলে আরেক ঠিকাদার হাফিজুর রহমান ২০১৪ সালের ১৬ জুন হাইকোর্টে একটি রিট করেন। আদালতের নির্দেশে নতুন করে টেন্ডার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে টানা ১০ বছর একই প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করে আসছেন।
দরপত্র অনুযায়ী, হাসপাতালে জনপ্রতি দৈনিক বরাদ্দ ১০৯ টাকার খাবার। এই টাকায় প্রত্যেক রোগীকে সকালের নাস্তা হিসেবে ১০০ গ্রাম পাউরুটি, একটি ডিম ও দুই পিস কলা পাওয়ার কথা। আর দুপুরে ভাতের সঙ্গে ৮০ গ্রাম মাছ বা মাংস, ২০ গ্রাম ডাল এবং রাতে ভাত, ডিম ও সবজি প্রাপ্য। কিন্তু সেটি পরিপূর্ণভাবে পাচ্ছেন না রোগীরা। একদিকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দায়সারা খাবার সাপ্লাই দিচ্ছে, অপরদিকে সেই খাবারের অর্ধেকের বেশি আত্মসাৎ করছেন হাসপাতালের স্টুয়ার্ড শাহাজাহান ও রাধুনী ফারুক হোসেন বলে অভিযোগ করছেন হাসপাতালের কর্মচারী ও রোগীর স্বজনরা। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে খোদ তত্ত্বাবধায়ক গোপনে খোঁজ নিয়ে তার সত্যতা পান। এ ঘটনায় স্টুয়ার্ড শাহাজাহানকে প্রথমবারের ন্যায় সতর্ক করা হয় এবং রাধুনি ফারুক হোসেনকে সরিয়ে তত্ত্বাবধায়কের অফিস সহকারী করা হয়েছে। বর্তমানে রাধুনির দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল মালেক।
হাসপাতালে প্রতি রোগীর জন্য খাদ্যে দিনে ১০৯ টাকা বরাদ্দ থাকে। খাদ্য সরবরাহ বাবদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বছরে প্রায় ১ কোটি পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর বরাদ্দের খাবার খেয়ে সুস্থ হওয়ার চেয়ে অসুস্থ হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। খাবারের পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পেলে রোগীরা উপকৃত হতেন। এজন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের জিম্মিদশা থেকে খাবার সরবরাহ কার্যক্রম মুক্ত করার দাবি রোগী ও স্বজনদের।
হাসপাতালের মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রাজিয়া সুলাতানা অভিযোগ করে বলেন, ২০০ গ্রাম চালের ভাত দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় এক ছটাক বলে অেিভযাগ রোগী ও তার স্বজনদের। এছাড়াও নামেমাত্র মাছ মাংসের টুকরো। মাছ-মাংসের গন্ধ থাকে ঠিকই, কিন্তু এক টুকরোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ভাতের পরিমাণও কয়েক মুঠোর বেশি নয়। আর ডাল তো পানিতে ভরা, তরকারির মধ্যে এক চামচ ডাল দিয়ে দায়সারাভাবে তৈরি করা হয়।
তানিয়া নামে অপর রোগী বলেন, নিম্নমানের ও পরিমাণে খুবই কম হওয়ায় রোগীরা এই খাবার মুখে নিতে পারে না। অনেকে খাবার নেন না।
তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় গতকাল বুধবার খাবারের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। প্লেট ভর্তি ভাত ও দুই টুকরো মুরগির মাংস, ঘন ডাল, রাতে সবজি সবই যেন কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন রোগীরা। তারা বলছেন, মাছের টুকরোও বড় হয়েছে আগের তুলনায়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, উচ্চ আদালতের মামলার নিষ্পত্তির বিষয়ে রিট করা হয়েছে। এবং আজ প্রতিমন্ত্রীর সাথে হাসপাতালের সভাকক্ষে সভা রয়েছে। বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। খুব শিগগির এই সমস্যা কাটিয়ে নতুন টেন্ডার করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী।
বরাবরই রোগী ও তার স্বজনরা খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে হাসপাতালের স্টুয়ার্ড শাহাজাহান দাবি ছিলো নির্ধারিত পরিমাপেই মান সম্মত খাবার সরবরাহ করা হয়। তবে সোমবার থেকে খাবারের মান ও পরিমাপ বেড়েছে। আগেও যা বরাদ্দ ছিলো এখনোও তাই আছে। কি কারণে বেড়েছে সে প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, আমি তো রাধুনিকে সব কিছু বুঝিয়ে দিতাম এখন সে যদি আত্মসাৎ করে, সেখানে আমার কি করার আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের তিনজন কর্মচারী বলেন, নিয়ম হলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর প্রতিদিনের খাবার বুঝে নেবে। কিন্তু এই হাসপাতালে তা হতো না। কোনো নজরদারি ছিলো না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামাফিক খাবার সরবরাহ করত। তা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক এসে সকল দিকে নজরদারি বাড়িয়েছেন। যার কারণে বর্তমানে রোগীদের খাবারের মান বৃদ্ধির সাথে সাথে রান্নার মানও বেড়েছে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, তিন বেলা এই খরচে খাদ্যের মান ও পরিমান ঠিক রাখা একটু কঠিন ব্যাপার। তারপরও আমি ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। যতটুকু সম্ভব কম লাভ করে রোগীকে ভাল মানের খাবার দেয়া যায়, সে ব্যাপারে আমি তাদের বলেছি এবং তারা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালের দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে রোগীদের অভিযোগ ছিলো তারা খাবার আত্মসাৎ করে। সত্যতাও মিলেছে। এ কারণে একজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, অপরজনকে সতর্ক করা হয়েছে এবং নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তবে এই সব অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদার শফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।