ক্রীড়া ডেস্ক: লিওনেল মেসি গোল করে শেষ কবে এমন রিঅ্যাকশন দিয়েছেন! শেষ কবে তাঁর বডিল্যাঙ্গুয়েজে এত বন্যভাব দেখা গিয়েছিল! আমাদের কথা ছেড়ে দিন। মেসির পরিবার, কাছের বন্ধুবান্ধব, এমনকি তাঁর দলের সতীর্থরাও হয়তো মনে করতে পারবেন না। একবার ভেবে দেখুন, এই ম্যাচটা খেলতে নামার আগে তিনি ও তাঁর দল আর্জেন্টিনা কতটা চাপে ছিল। সন্ধ্যায় পোল্যান্ড জিতে যাওয়ায় ম্যাচটা নীল-সাদা ব্রিগেডকে জিততেই হত।
হারলেই দেশে ফেরার টিকিট কনফার্ম। এই লুসেল স্টেডিয়ামেই তো ২২ নভেম্বর সৌদি আরবের কাছে এগিয়ে থেকেও ১-২ ব্যবধানে হারতে হয়েছিল। তবে ২৪ নভেম্বর সব অপমান, জ্বালা সুদে-আসলে তুলে নিলেন ‘এলএমটেন।’ শেষ বেলায় মেক্সিকোর জালে বল জড়িয়ে দলের জয়কে ২-০ করে দিলেন তরুণ এনজো হার্নান্ডেজ। আর তাই অনেক অপমানের জবাব দিয়ে বিশ্বকাপ যুদ্ধে বেঁচে রইল আর্জেন্টিনা।
প্লিজ একবার ভেবে দেখুন। দিয়েগো মারাদোনা বেঁচে আছেন। প্লিজ একবার ভেবে দেখুন, ঠিক যেভাবে তাঁকে ২০১৪ সালের ব্রজিল কিংবা ২০১৮ সালে রাশিয়ার স্টেডিয়ামগুলোর ভিআইপি বক্সের নির্দিষ্ট আসনে তিনি বসতেন, লুসেল স্টেডিয়ামেও তিনি উপস্থিত আছেন! পরিবেশটা একবার কল্পনা করতে পারছেন! দু’বছর হল দিয়েগো তাঁর দরজা আজীবনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন।
তবুও তিনি আছে মেসির হ্রদয়ে। সব আর্জেন্টাইনদের মনে। কয়েক ঘণ্টা আগেই দিয়েগো দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। আর এর কয়েক ঘণ্টা পর ৯০ মিনিটের যুদ্ধে মেসি ও তাঁর দলের মহাকাব্যিক কামব্যাক ঘটল। শুধু ফুটবল খেলে এমন প্রত্যাবর্তন সম্ভব! মেসির সঙ্গে কি দিয়েগোর ম্যাজিকও কাজ করেছিল! কে জানে! মরণ বাঁচন ম্যাচের আগে মেসি তাঁর ‘ফুটবল আইডল’-কে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। অনেক অপমান সহ্য করার পর ‘গুরু দক্ষিণা’ পেলেন মেসি। এটা লিখে দেওয়াই যায়।
রেফারি হাফ টাইমের বাঁশি বাজাতেই ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, মেসির ও তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নের মাঝে তাহলে আর মাত্র এক ঘণ্টার কিছু সময় বাকি! ফুটবল দেবতা সত্যি এত নিষ্ঠুর! প্রথমার্ধে একাধিক চেষ্টার পরেও গোলের দেখা নেই। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তাঁর ঝলক দেখা গেলেও, কোপা আমেরিকার আর এক প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মরণ বাঁচন ম্যাচে কেমন যেন চুপসে গিয়েছেন! বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, আটকে যাচ্ছেন মেক্সিকোর জমাটি রক্ষণের সামনে। কিন্তু তিনি যে মেসি। খেলা বদলে দিতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড লাগে। সেটাই করলেন ‘ম্যাগনিফিসেন্ট মেসি’।
‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ বলে কথা। প্রত্যশামতোই প্রথম একাদশে পাঁচটি বদল এনেছিলেন লিওনেল স্কালোনি। বদলে ফেলেছিলেন রক্ষণ থেকে মাঝমাঠ। মাঝমাঠ বদলে ফেলার বড় কারণ মেসি যাতে বেশি থ্রু বল পায়ের কাছে পান। শুরুটা দুর্দান্ত হল আর্জেন্টিনার। প্রথম থেকেই বল মেসিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে মেক্সিকোও হাল ছাড়েনি। খেলায় ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছে কোচ টাটা-র দল। হাই প্রেসিং ফুটবল খেলে দু’বার গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তারা। স্বভাবতই তখন গোল করার চেয়ে রক্ষণ নিয়ে বাড়তি সতর্ক হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা।
আসলে মেক্সিকোর তো কিছু হারানোর নেই। বরং আর্জেন্টিনা গোলের খাতা খুলতে না পারলে অতলে হারিয়ে যাবে। সেটা জানতেন মেসির প্রাক্তন কোচ। আর তাই হাই প্রেসিং ফুটবলের সঙ্গে চলল তাঁর নির্দেশে নীল-সাদা ব্রিগেডের উপর চোরা আক্রমণ। গিয়ের্মো ওচোয়া আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন যে, মেসিকে তিনি ‘ম্যাজিশিয়ান’ মনে করলেও এই ৯০ মিনিটের যুদ্ধে ঠিক বুঝে নেবেন। প্রথমার্ধে কথা রাখলেন রবার্ট লেওনডস্কির পেনাল্টি রুখে দেওয়া ৩৭ বছরের গোলকিপার। শুধু মেসি কেন, তাঁর বাকি সতীর্থরাও ওচোয়া এবং মেক্সিকোর রক্ষণের সামনে এঁটে উঠতে পারলেন না। ফলে প্রথমার্ধ শেষ হল গোলশূন্যভাবে।
নিজের দীর্ঘ কেরিয়ারে ২০ গজ দূর থেকে বলে বলে অগণিত ফ্রি-কিক মেরেছেন মেসি। ফিফা অঘোষিত ভাবে সেই অঞ্চলকে ‘মেসি জোন’ করে দিতেই পারত। ক্লাব ফুটবল থেকে জাতীয় দলের জার্সি, বক্সের বাইরে থেকে অতি অনায়সে বলকে বিপক্ষের জালে জড়িয়েছেন। গোলের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। ইউ টিউব-এ গিয়ে ‘মেসি অল গোলস’ দিয়ে সার্চ করলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে একাধিক লিঙ্ক। কিন্তু সমস্যা হল সেগুলো সব অতীত। কঠিন ও রুক্ষ বাস্তব হল, মরণ বাঁচন ম্যাচে মেসি সেই ফ্রি-কিক থেকে গোল করতে পারলেন না।
৫০ মিনিটে তাঁকে বক্সের বাইরে ফাউল করা হল। বিপক্ষের ডিফেন্ডার গুতিয়েরেজ অবধারিত হলুদ কার্ড দেখলেন। সঙ্গে ফ্রি-কিক পেল আর্জেন্টিনা। খুব স্বাভাবিকভাবেই বল পায়ের সামনে সাজিয়ে স্টান্স নিলেন দলের অধিনায়ক। কিন্তু পারলেন কোথায়! জোরালো শটে বলকে বাঁক খাইয়ে জালে ঢুকিয়ে দেওয়ার বদলে ক্রস বারের অনেক উপর দিয়ে চলে গেল। মেসির জন্যই মোক্ষম সুযোগ হারাল তাঁর দল। সেই সময় মনে হচ্ছিল, তাহলে খালি হাতে দেশে ফেরা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। লুসেল স্টেডিয়াম ও তামাম দুনিয়ার ওই নিল-সাদা জার্সি গায়ে চাপানো মানুষগুলোর রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছে। চোখের কোণে নির্ঘাত জমতে শুরু করে দিয়েছে জল। ঠিক এমন সময় গোটা দুনিয়ার আর্জেন্টাইনদের একেবারে রাঙিয়ে দিলেন দিয়েগোর যোগ্য উত্তরসূরি। ৬৪ মিনিটে দুর্দান্ত গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলেন সেই মেসি। ডান দিক থেকে দি মারিয়া পাস দিয়েছিলেন মেসিকে।
বাঁ পায়ের মেসির গড়ানো শট গোলকিপার ওচোয়াকে পরাস্ত করে জালে জড়িয়ে যায়। আনন্দের জোয়ারে ভেসে ওঠে লুসেল স্টেডিয়াম ও পৃথিবীর কত অজানা পাড়া, গলি, এলাকা, বস্তি। কোটিপতি থেকে দু’বেলা রিক্সা টানা মানুষ, সবার চোখে তখন আনন্দের কান্না। বিশ্বকাপে ম্যাচের সংখ্যায় ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগোকে ছুঁলেন মেসি। বিশ্বকাপে ২১ নম্বর ম্যাচ খেলছেন মেসি। বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর অন্যতম কঠিন ম্যাচ। ম্যারাদোনার বিশ্বকাপে রয়েছে ৮ গোল, মেসি তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম কঠিন ম্যাচে গোল করে এবার তাঁর ‘আইডল’-কেও ছুঁলেন।
আর মেসি, তাঁর সেই শট বিপক্ষের জাল ঢুকতেই শিশুদের মতো সতীর্থদের সঙ্গে মেতে গেলেন ছোট্ট উৎসবে। চললো কয়েক মিনিটের সেলিব্রেশন। তারপর ফুটবল দুনিয়া যে দৃশ্য দেখল, সেটা হয়তো কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। দুটি চোয়াল একেবারে শক্ত।
দৃপ্ত দুই চোখ তাকিয়ে আছে গ্যালারি ভরানো অগণিত আর্জেন্টাইনদের দিকে। তাঁদের দিকে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিছু একটা বললেন। সরি, বললেন লেখা ভুল। চিৎকার করে হয়তো বলে উঠলেন, আমি তো আছি। চিন্তা কিসের! আমরা ঠিক পারব।’ খেলা তখন প্রায় শেষের দিকে। ৮৭ মিনিটে বক্সের ডান দিক থেকে দু’জন ডিফেন্ডারকে পায়ের দোলায় কাটিয়ে গোলের কোণ দিয়ে দিয়ে বল জালে জড়ালেন তরুণ এনজো হার্নান্ডেজ।। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল মেসির দল।
লুসেল স্টেডিয়ামের সিংহভাগ গ্যালারিতে নীল-সাদা জার্সির সমর্থকরা ম্যাচ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভিড় বাড়িয়েছিলেন। অনবরত গেয়ে যাচ্ছিলেন স্প্যানিশ ভাষায় গান। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘আমরা আবারও লড়াই করব। আমরা চ্যাম্পিয়ন হব।
যেভাবে আমরা ‘৮৬-তে হয়েছিলাম। এসো, আমাদের সঙ্গে গান গাও। তুমি বন্ধু খুঁজে পাবে। এবং লিও মেসির হাত ধরে। আমরা সমস্ত মাঠে রাজত্ব করব।’ ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল একনাগাড়ে ঢাক, ঢোল পিটিয়ে যাওয়া ওই পাগল সমর্থকরা শুধুই কি লিওনেল মেসির জন্য এসেছেন! নাকি তাঁরা কাতারে এসেছেন তাঁদের ‘ফুটবল দেবতা’ দিয়েগো মারাদোনার বিশেষ বার্তা নিয়ে। সেই বার্তাই হয়তো কাজে দিল। ফুটবল দেবতা কি ‘ফুটবলের রাজপুত্র’-এর কথা ফেলে দিতে পারেন!