নিজস্ব প্রতিবেদক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে যশোরের ৬টি আসনের মধ্যে এক সঙ্গে কপাল পুড়েছে দুই সাংসদের। ৬টি আসনের মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে মাত্র দুটি আসনে। বাকী ৪টি আসনেই বর্তমান সংসদ সদস্যরাই দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি যশোর-৪ (বাঘারপাড়া- অভয়নগর) আসনে রণজিত কুমার রায় ও যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন। তাদের জায়গায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ঝিকরগাছা-চৌগাছা আসনে বিশিষ্ট চিকিৎসক তৌহিদুজ্জামান তুহিন ও বাঘারপাড়া-অভয়নগর আসনে এনামুল হক বাবুল।
কেন তাদের কপাল পুড়ল, এই প্রশ্নে চলছে নানা আলোচনা। দলীয় সূত্র বলছে, দুই সংসদের কপাল পুড়েছে দলীয় নেতাদের মূল্যায়ন না করা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে। আর নতুন দুই জনের মধ্যে বাবুলের কপাল খুলেছে দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা হিসাবে। আর তুহিনের ভাগ্য খুলেছে দলের প্রবীণ নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের জামাতা হিসাবে। এছাড়া বিশিষ্ট হৃদরোগ চিকিৎসক হিসাবে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীসহ দলের শীর্ষ মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতার সুযোগে পেয়েছেন দলীয় মনোনয়ন বলেও মনে করেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ পদে এই দুই পরিবর্তন ভোটের মাঠে কতটা কাজে দেয়, সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে। দলের ভেতরে এরই মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই দুই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আভাস মিলছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনেই রয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি। কিন্তু ছয় এমপির সঙ্গেই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরোধ স্পষ্ট। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে এ কোন্দল আরও বাড়ে দ্বিগুণ। দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মসূচিও পালন করেন পৃথকভাবে। দলীয় কোন্দল আর নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করায় এবার কপাল পুড়তে পারে একাধিক এমপির সেটা আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন নেতাকর্মীরা।
অভয়নগর-বাঘারপাড়া উপজেলা এবং সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন যশোর-৪। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য রণজিত রায়। আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের মেয়াদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। বরং নানা বির্তকের জন্ম দিয়ে দিনকে দিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। নিজের চতুর্থ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন কেনার এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়েও দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের কোন শীর্ষনেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। বরং নাশকতা মামলার আসামি ও বিএনপির নেতাদের নিয়ে তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, রনজিৎ সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিয়োগবাণিজ্যে পুনর্বাসিত করেছেন জামায়াত-বিএনপিদের। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকারদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীকে নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যা নিয়ে উপজেলা নেতাকর্মীর মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। এ সংক্রান্ত সংবাদ দৈনিক কল্যাণে একাধিবার প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনা নিয়ে দুই উপজেলা ও তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দুই উপজেলায় শীর্ষ নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মঞ্চে দেখা যায়নি দীর্ঘদিন। এমপির সঙ্গে নানা কারণে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় নির্বাচনে দলের ১৫ নেতা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন।
বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী বলেন, রণজিত রায় তো আওয়ামী লীগ করেন না। তাই এমপি হয়েও দলীয় মনোনয়ন কেনার সময় দুই উপজেলার কোন শীর্ষ নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে ছিলেন না। নিজের ক্ষমতা চালান বিএনপি ও জামায়াতের লোক দিয়ে। দুই উপজেলার যত নিয়োগ হয়; চাকরি দিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনদের। আমজাদ রাজাকারের পরিবারকে সমর্থন দিয়েছেন। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেও জানানো হয়েছে। বির্তকিত হওয়াতে দল তাকে মূল্যায়ন করেনি। দল যাকে প্রার্থী করেছে তাকে আমরা বিজয়ী করবো।
সাংসদ রণজিত রায় বলেন, ‘দল আমাকে কেন মনোনয়ন দেয়নি সেটা দল জানে। আর নৌকার পক্ষে কাজ করবেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এই প্রসেঙ্গ তিনি আর মন্তব্য করতে ইচ্ছা পোষণ করেননি।’
এই আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া এনামুল হক বাবুল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। এর আগেও মেয়র ছিলাম। জনপ্রিয়তা আছে বলেই দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। দুই উপজেলার নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে নৌকাকে বিজয়ী করবো।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নানা সময়ে সমালোচিত রনজিত যাতে এবার দলীয় মনোনয়ন না পায় সেক্ষেত্রে উপজেলার নেতারা এক জোট হন। রনজিতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন। রনজিত এবার মনোনয়ন না পাওয়াতে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করছে। এমনকি রনজিত বিপক্ষের জোটের মধ্যে এবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বাবুলের বিরুদ্ধে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন না বলে জানা গেছে।
ঝিকরগাছা-চৌগাছা উপজেলা নিয়ে যশোর-২ আসন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন। এই আসনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দশম সংসদের নির্বাচনে বিজয়ী অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলামের জায়গায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিনকে। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধের কারণে তাদের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। দীর্ঘদিন তারা এক মঞ্চেও বসেন না। তারা দলীয় কর্মসূচিও পালন করেন পৃথকভাবে। দলীয় কর্মসূচিতে একে অন্যকে ঘায়েল কওে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।
ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল ও সাধারণ মুছা মাহমুদ এবং চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম হাবিব ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী মাসুদ চৌধুরীর সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্যের দূরত্ব রয়েছে। দুই উপজেলার সভাপতি-সম্পাদকের অভিযোগ বর্তমান এমপির স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করাতে উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। এছাড়া দুই উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্যের নামে জামায়াত-বিএনপিদের পুনর্বাসিত করারও অভিযোগ রয়েছে এমপি নাসিরের বিরুদ্ধে। এসব কারণে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
তবে তুহিন ইস্যুতে পুরো দল বিভক্ত। দুই উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিকরাগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন সাবেক সংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। অন্যটি বর্তমান সংসদ নাসির উদ্দিন। এই দ্বন্দ্বের জেরের মধ্যে নৌকার মাঝি হতে প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়ন কিনেছিলেন ১৯ জন। গুঞ্জন উঠেছে সাবেক সাংসদ মনিরুল এবং বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রনালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। মনিরুলের অনুসারীদের ভাষ্য, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসতে নাও পারে। সেক্ষত্রে বড় কোন শক্তিশালী প্রার্থী থাকবে না এই আসনে। স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে মনিরুল ব্যাপক ভোটে নির্বাচিত হবেন। কেননা মনিরুলের দুই উপজেলায় দলের শীর্ষ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। মনিরুলের নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেখানে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া তুহিন অরাজনৈতিক। চলতি বছরের আগস্ট থেকে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য সমাবেশ শুরু করেছিলেন। দুই আসনেই অপরিচিত এই প্রার্থী যদি তৃর্ণমূলের নেতাকর্মীরা প্রত্যাখান করেন তাহলে এই আসনে নৌকার ফলাফল পরিবর্তন হতে পারে। তবে মনিরুল বিষয়টি নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে বক্তব্য নেয়ার জন্য কয়েক দফা মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ডা. নাসির উদ্দিন রিসিভ করেননি।