কল্যাণ ডেস্ক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাত দিনদিন তীব্র হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরে বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনীর দুটি চৌকির দখল নিয়ে শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে কেঁপে ওঠে সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা।
গত ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও জনপ্রতিনিধিদের ধারণা, এই সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি।
সব মিলিয়ে গত প্রায় এক মাসে ঠিক কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি বলছে, অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মিয়ানমারের মংডু শহরে সংঘাত সম্পর্কে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে মংডু শহরে নিজেদের দুটি চৌকির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আরাকান আর্মির সদস্যদের লক্ষ্য করে মর্টার শেল ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিজিপি ও জান্তা বাহিনী। এতে সীমান্তের ওপার থেকে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। এসব শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা টেকনাফ।
একই কথা বলেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন। তিনি জানান, মর্টার শেল ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণে বাড়িঘর কেঁপে ওঠায় রাতভর আতঙ্কের মধ্যে ছিল সীমান্ত এলাকার মানুষ।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তের ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দালালদের সহায়তায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে। এমনটা বলেছেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
তিনি জানান, অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ক্যাম্পে প্রবেশ করলেও অনেকেই উখিয়া ও টেকনাফে বাসা ভাড়া নিয়ে আছেন। বাংলাদেশে ঢোকার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছে হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের প্যারাংপুরু নামের এলাকায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত আগস্ট মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে। জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা দেশে প্রবেশ করেছে।
মংডুর উত্তরে প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় এই অনু্প্রবেশ অব্যাহত রেখেছে বলে জানান তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলছেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কয়েকজনকে বিজিবি সদস্যরা আটক করেছে। গত শুক্রবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপ থেকে অনুপ্রবেশের সময় আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের বিজিবির একটি গাড়িতে করে টেকনাফের দিকে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
দালালের সহায়তায় নৌকায় করে নাফ নদী অতিক্রম করে রোহিঙ্গাদের দেশে অনুপ্রবেশের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজির আহমদ। তিনি বলেন, “গত কয়েকদিনে কেরনতলি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এলাকাবাসীর সহায়তায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিজিবি তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।”
শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গাশূন্য। সেখানে উভয় পক্ষ গ্রেনেড, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। প্রাণরক্ষায় যে যেদিকে পারছে, পালাচ্ছে। দালালদের জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছে।
লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে বলে জানান তারা। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হোসেন বলেন, “নতুন করে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”
টেকনাফে কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা স্বীকার করে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, “ক্যাম্পে নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে।”
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, “সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। তাদের নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।”
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, “আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে-পরে ৮ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য। আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া গেলেও তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।”
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, “সীমান্তে কঠোর এবং সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। যারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে, তাদের প্রতিহত করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশের সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য বিজিবির কাছে নেই বলে জানান তিনি। বাংলাদেশে কত রোহিঙ্গা আছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। তাদের সঠিক সংখ্যা জানাতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আগামী বছরের জুনে একটি জরিপের প্রাথমিক তথ্য তুলে ধরবে। গত ১১ জুন এবিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিল বিবিএস। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) গত ৩১ জুলাইয়ের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে এখন ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫৮৫ জন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।