নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য রনজিৎ রায়ের ছত্রছায়ায় থেকেও শেষ রক্ষা হলো না বাঘারপাড়ার আমজাদ হোসেন মোল্লাসহ চারজনের। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের রশিতে ঝুলিয়ে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।
২০১৭ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে শেল্টার দিয়ে গেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রণজিৎ রায়। আসামির স্বজনদের একের পর এক শেল্টার দেয়ার কারণে বেপারোয়া হয়ে ওঠে বাঘারপাড়ার প্রেমচারা এলাকার ‘আমজাদ রাজাকার’ বাহিনী। সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বাদী, স্বাক্ষী ও স্বজনদের বাড়ি ভাংচুর, হত্যা হুমকির দিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে এক স্বাক্ষীর ভাইকে। এভাবে একের পর এক অভিযুক্তদের মদদ দেয়া ও চিহ্নিত রাজাকার আমজাদ মোল্যার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঘারপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন তার উপর ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যশোরের সুশীল সমাজ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ।


যশোর জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক সাজেদ রহমান বকুল বলেন, ‘আমজাদ রাজাকার যাতে এই মামলা থেকে রেহাই পায় সেজন্য এমপি রনজিৎ সকল চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি তার ছত্রছায়াতে এই রাজাকার বাহিনী প্রেমচারা এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্বাক্ষী ও স্বজনদের হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের উপর হামলা মামলাও করিয়েছেন তিনি। যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি একাধিবার সংবাদ সম্মেলন ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। নিহত রজব আলী বিশ্বাসের ছেলে ও যুদ্ধাপরাধ মামলার স্বাক্ষী খলিলুর রহমান বলেন, ‘স্বাধীন দেশে রাজকাররা সাহসী হয়ে উঠে সংসদ সদস্য রনজিৎ রায়ের ছত্রছায়ায়। তার আস্কারায় আমজাদ রাজাকার বাহিনী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। রণজিৎ ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে বাদী ও তার স্বজনদের বাড়িঘর ভাংচুর করে। শুধু ভাংচুর নয়; প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আমজাদের হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির দলের জনপ্রতিনিধি রণজিৎ রায় এমন কোন কাজ নেই যা করেননি। তাদের সাথে সভা-সমাবেশে; খাওয়া-দাওয়া সবই করে গেছেন একনাগাড়ে। আমজাদ মোল্লার সভাপতিত্বে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবেও ছিলেন একটি অনুষ্ঠানে। এ কারণে রনজিৎ কুমার রায়ের ওপর ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী।
গতকাল রোববার আমজাদসহ চারজনের ফাঁসির রায় দিলে ওই সব দিনের কথা আলাপ-আলোচনা হতে শোনা যায় বাঘারপাড়া ও পাশের উপজেলা শালিখায়।

খাজুরা এলাকার রহিম উদ্দিন নামে একজন বলেন, এমপি রণজিৎ বাঘারপাড়ার চিহ্নিত রাজাকার আমজাদ মোল্যার পক্ষে তা গোটা এলাকার মানুষ সবাই জানেন। কারণ এমপি সাহেব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করেছেন। তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে এসেছেন। ২০১৭ সালে প্রেমচারাতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধী আমজাদ রাজাকার। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য রনজিৎ রায়। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করায় সাক্ষীদের উপর সন্ত্রাসী হামলা ও শহীদদের বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত টুটুল মন্ডল, শওকত মন্ডলসহ আমজাদ রাজাকারকে নিয়ে নির্বাচনী সভাও করেছেন। এসব ছবি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয় একাধিকবার। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে আমজাদ রাজাকারের পুত্রবধু জোৎস্না বেগম এমপির ন্যাম ভবনের ফ্লাটে যেয়ে মিষ্টিমুখ করান। এমন একটি ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পেলে সমালোচনার ঝড় উঠে। সে সময় তা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় সংবাদ।
ফিরে দেখা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান :
২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বাঘারপাড়ার প্রেমচারা স্কুল মাঠের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন এমপি রণজিৎ রায়। আর অনুষ্ঠানের ব্যানারে সভাপতি হিসেবে লেখা ছিল বাঘারপাড়ার আলোচিত আমজাদ হোসেন মোল্লার নাম। এর আগে মার্চ মাসে বাঘারপাড়া এই কুখ্যাত রাজাকার এমপি রণজিৎ রায়ের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। পহেলা বৈশাখারে অনুষ্ঠানে এমপি রণজিৎ রায় ছাড়াও বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু, বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সামাদ মন্ডল, সম্পাদক আব্দুল হামিদ ঢাকু, সাবেক বন্দুবিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শওকত হোসেন মন্ডল, বহুলালোচিত সন্ত্রাসী টুটুল মন্ডল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য আলম মোল্যা, রাজাকার আমজাদ মোল্যার সহযোগী কেরামত মোল্য, রাজাকার ওহাব মোল্যা ও ফসিয়ার মোল্যা এবং আদম ব্যবসায়ী মহসীন বিশ্বাস।

অনুষ্ঠান শুরুর আগে আদম ব্যবসায়ী মহসীন বিশ্বাসের বাড়িতে রাজাকার আমজাদ মোল্যাসহ অন্যান্যদের সাথে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন এমপি রণজিৎ রায়। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের জন্য ৩০ টি ছাগল জবাই করে বিরিয়ানি রান্না করে প্যাকেট করে তা বিতরণ করা হয়। একজন স্বীকৃত রাজাকারের সভাপতিত্বে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের এমপি বক্তব্য রাখায় বাঘারপাড়ার সর্বত্র ধিক্কার জানান মুক্তিযোদ্ধারা। এ নিয়ে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠে সংবাদ প্রকাশও হয় সে সময়।
রাজাকারদের নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ, রাজাকারের পরিবারে যাতায়াত, পুত্রবধূর কাছে মিষ্টি খাওয়া এবং আমজাদ রাজাকার ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা করার বিষয়ে রোববার রাতে মুঠোফোনে জানতে চাইলে এমপি রনজিৎ রায় কোন বিষয়ই অস্বীকার করেননি। উপরন্তু তিনি বলেন, ‘আমিও ত রাজাকার ছিলাম।’ অভিযোগগুলোর কোন ছবি থাকলে সেগুলো পত্রিকায় ছেপে দিতেও বলেন তিনি।
১ Comment
so sad