নিজস্ব প্রতিবেদক
সোমবার ও আজ মঙ্গলবার দৈনিক কল্যাণ ছিল টক অব দ্যা যশোর। ‘আমজাদকে শেল্টার দিতেন এমপি রণজিৎ’ শিরোনামে খবর ছিল সব শ্রেণি পেশা ও রাজনৈতিক দলের কাছে আলোচনার বিষয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও আমজাদসহ রোববার ফাঁসির আদেশ দেয়া চারজনকে ২০১৭ সাল থেকেই শেল্টার দিয়ে আসছিলেন এমপি রণজিৎ রায়। তাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় সভা সমাবেশ ও খাওয়া দাওয়া করেন তিনি। এমপির আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে বেপরোয়া আমজাদ রাজাকার বাহিনী বাদী ও স্বজনদের নির্যাতন করে। হামলা-ভাংচুর চালায়। স্বাক্ষীর ভাইকে হত্যা করে। সেই সব তথ্য ও চিত্র নিয়ে দৈনিক কল্যাণ পত্রিকায় খবর ও দৈনিক কল্যাণের ফেসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও প্রকাশ হয়। বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী প্রতিবেদন পড়ে পাঠক ধন্যবাদ জানায় দৈনিক কল্যাণকে। সম্প্রতি সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পত্রিকা ছাপা হলেও বাঘারপাড়া-অভয়নগরসহ যশোর শহরের পত্রিকা এজেন্টগুলো ও হকারদের কাছ থেকে এদিন বেলা ১১ টার মধ্যে পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। এমনকি অসংখ্য পাঠক দৈনিক কল্যাণ কার্যালয়ে পত্রিকা কিনতে এসে না পেয়ে ফিরে যান। কোন কোন স্থানে ফটোকপি করে বিক্রি হয় পত্রিকার কপি। কেউ কেউ ই-পেপার শেয়ার দেন ফেসবুকে।ফেসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও হাজার হাজার মানুষ ভিউ করে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে, চায়ের দোকানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধি রণজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধীদের শেল্টার দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পাঠকরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যশোরের সুশীল সমাজ ও মুক্তিযোদ্ধারা।
সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, আমজাদ রাজাকার ছিলেন বাঘারপাড়ার চিহ্নিত রাজাকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জামায়াত বিএনপি থেকে তিনি স্থানীয় সংসদ রনজিৎ রায়ের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন আমজাদ মোল্লা। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার পরেও বারবার স্থানীয় সাংসদ তাকে শেল্টার ও বিভিন্নভাবে মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য সহযোগিতা করে গেছেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধারাও এই বিষয় নিয়ে কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন করেছি। রনজিৎ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন না। তিনি সুবিধাবাদী। তাই তিনি সুবিধা নেয়ার জন্য রাজাকার জামায়াত বিএনপির লোকদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়েও তিনি রাজাকারদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়াতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
যশোর জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমজাদ রাজাকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী মামলা হওয়ার পর থেকে আমরা বারবার প্রশাসন তথা সকল স্তরে জানিয়েছি স্থানীয় সাংসদ এই মামলা থেকে রাজাকার পক্ষীয়দের রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছেন। আমরা একাধিকবার মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছি। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কোনকিছুই থামাতে পারেনি এমপি রনজিৎকে আমজাদ পক্ষীয়দের রক্ষার চেষ্টা থেকে।’
এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। একই সাথে তারা দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানানোর পাশাপাশি তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকার কথাও প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, আমজাদ মোল্লার স্থানীয় সঙ্গীরা এখন আরো বেপরোয়া হয়ে তাদের ও তাদের পরিবারকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সাক্ষী এহিয়ার রহমান বলেন, এমপি রনজিতের ছত্রছায়ায় থেকে আমজাদ মোল্লার বাহিনী আমাদের উপর নির্যাতন, হত্যা-মামলা করেছে। আমার ভাইকে হত্যা করেছে ওই বাহিনী। এমপি মদদ না দিলে এত বড় সাহস হয় নাকি আমজাদ বাহিনীর।
নিহত রজব আলী বিশ্বাসের ছেলে খলিলুর রহমান ওরফে খোকন বিশ্বাস বলেন, এতবছর পর পিতা হত্যার বিচার পেয়েছি। মামলা করার পর থেকে প্রতিনিয়ত নিজের ও পরিবারের জীবন নিয়ে শংসয়ে থেকেছি। বারবার নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু এমপি রনজিতের মদদ থাকায় প্রতিকার ত পায়ইনি বরং আমজাদ বাহিনী আমাদের ঘর বাড়ি ভেঙেছে। আমাদের নামে মামলা করেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে।
আমজাদ মোল্লার হাতে নিহত ডা. নওফেল উদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে ডা. এবিএম রুহুল আমিন বলেন, আমরা শুরু থেকে সবাইকে বলেছি আমজাদ বাহিনীর পিছনে এমপির হাত আছে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনেও কিছু করেনি বা করতে পারেনি ওই এমপির কারণেই। এখনও আমজাদ বাহিনী আমাদের হুমকি দেয় কেননা তারা জানে তাদের পেছনে এমপি থাকবেই।
বাঘারপাড়ার উত্তর চাঁদপুর গ্রামের সাক্ষী আলাউদ্দীন বিশ্বাস বলেন, আমরা মামলা করার পর আমজাদ বাহিনীর হাতে বারবার নির্যাতিত হয়েছি। ট্রাইব্যুনালসহ সব জায়গায় বলেছি আমজাদ বাহিনীকে এমপি রনজিৎ মদদ দেয়। তারপরও আমাদের নিরাপত্তাহীনতা আজো কাটেনি। আল্লাহর অশেষ রহমতে বিচারে আমজাদ মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। এখন তার বাহিনীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেই আমরা নিরাপদে থাকতে পারবো।
এ ব্যাপারে বাঘারপাড়া থানার ওসি শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রেমচারা গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া যেকোনো ধরনের প্রয়োজন আমাকে অবহিত করলে সাথে সাথে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে আমি নিজে ওই এলাকায় গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যশোরের বাঘারপাড়ার মো. আমজাদ হোসেন মোল্লাসহ চার আসামির মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম। ২০১৭ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে শেল্টার দিয়ে গেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রণজিৎ রায়। আসামির স্বজনদের একের পর এক শেল্টার দেয়ার কারণে বেপরোয়া হয়ে ওঠে বাঘারপাড়ার প্রেমচারা এলাকার ‘আমজাদ রাজাকার’ বাহিনী। সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বাদী, স্বাক্ষী ও স্বজনদের বাড়ি ভাংচুর, হত্যা হুমকি দিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে এক স্বাক্ষীর ভাইকে। এভাবে একের পর এক অভিযুক্তদের মদদ দেয়া ও চিহ্নিত রাজাকার আমজাদ মোল্যার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঘারপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন তার উপর ক্ষুব্ধ।