দিনেও কামড়ায়
কয়েল-স্প্রে কোন কিছুতে মরেনা
সালমান হাসান: রাতের বেলা শুধু হুল ফোটায় ব্যাপারটি তেমন নয়। দিনের বেলায়ও কামড়ায়। যশোরের অবস্থা যেন ইশ্বর গুপ্তের সেই ব্যঙ্গ কবিতার মত। বলতে হয় রাতে মশা দিনেও মশা, যশোরবাসীর মরণদশা। সাড়ে চার লাখ মানুষের শহর যশোরের এখনকার এক নাগরিক দুর্ভোগের নাম হলো মশা। মশায় নাকাল যশোরবাসী। বাড়ির বাইরে রাস্তাঘাটেও মশারা হুল বসায়।
কানের পাশে গুনগুন করে গান গেয়ে বেড়ায়। রাতের মত দিনেও কামড়ায়। তাই সব সময় মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়-বলছিলেন সৃজনশীল বই প্রকাশনী ঐতিহ্যের যশোর আউটলেট নির্বাচিত’র ব্যবস্থাপক জহিরুল হক।
স্টেডিয়াম গ্যালারি মার্কেটের নির্বাচিত শাখায় আলাপচারিতার সময় জহিরুল সঙ্গে করে নিয়ে দেখালেন পৌরসভার ড্রেনের দশা। আর্বজনায় ভর্তি ড্রেনে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। স্থির জমে থাকা পানিতে মশা আর মশা। পাশাপাশি দেখা মিলল মশার শুককীটও (লার্ভা)। সেগুলোর পরিমাণও প্রচুর।
গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে যশোর শহরে মশক নিধন শুরু হয়। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর যশোর পৌরসভা মাসব্যাপী মশক নিধন শুরু করে। কিন্তু তখনও পৌরবাসীর অভিযোগ ছিলো কোন কাজ হয়নি। আর এখনকার অভিযোগ, মশার দৌরাত্ম্য চরমে পৌঁছেছে। এমনকি সেটি অস্বাভাবিক মাত্রায়।
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জাফর ইকবাল বলেন, তাদের ছাত্রাবাসে দিনের বেলাতেও মশার কয়েল জ¦ালিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তাতে তেমন একটা কাজ হয় না। সেজন্য সবসময় দড়িতে মশারি টাঙিয়ে রাখেন। দুপুরে ঘুমানোর সময় মশারি ফেলে ঘুমান। তিনি বলেন, কয়েলে কোন কাজ হয় না। তাই এই ব্যবস্থা; তার মতন অন্যরাও এমনটি করেন।
কীটতত্ত্বে অভিজ্ঞদের অভিমত, মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে মশার প্রজনন। এক্ষেত্রে শীতকালটা হলো ‘ডায়াপজ’। অর্থাৎ বিরতি দশা। গরমে এই দশা থেকে বেরিয়ে আসে রক্তচোষক ক্ষুদ্র এই পতঙ্গটি। উষ্ণতা বাড়লে শীতের প্রকৃতিতে নিষ্ক্রিয় ডিম ফুটতে থাকে। বৃষ্টি এটির ফার্টিলিটি রেট (প্রজনন হার) বাড়িয়ে দেয়। ফলে দিন কয়েক আগে বৃষ্টি হওয়ায় এই হার আরো বেড়ে গেছে। এতো গেল বিজ্ঞান নির্ভর তত্ত্বকথা। মশার এত অধিক্য বাড়ার পেছনে অন্যান্য অনেক কারণও আছে। নাগরিকদের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেগুলো।
জনউদ্যোগ যশোরের আহবায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমেদ মনে করেন শহরের ময়লা ঠিক মত অপসারণ হচ্ছে না। ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিস্কার হয় না। ফলে সেখানে মশার আস্তানা গড়ে উঠছে। ট্যাক্স দিয়েও এরকম নাগরিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মশার অত্যাচারে ঘরে টেকা দায়। মশার উপদ্রবে বাচ্চা অস্থির হয়ে পড়ছে। মশারি টাঙানো অবস্থায় ছাড়া তাদের লেখাপড়ায় বসানোর উপায় নেই। কারণ মশা মারা স্প্রে ও কয়েল দিয়ে উপদ্রব ঠেকানো যাচ্ছে না। দ্রুত মশক নিধনে পৌর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
যশোর শহরের লালদিঘির পাড়ের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রাদার টিটো’স হোম-এর পরিচালক ব্রাদার টিটো জানান, মশার উপদ্রব এখন ভয়ঙ্কর। নিজ উদ্যোগে চারপাশ পরিষ্কার করার পাশাপাশি কীটনাশক ছিটিয়ে উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তিনি মনে করেন, পৌর কর্তৃপক্ষের উচিত নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে মশক নিধনে অভিযানে নামা। তাহলে এটি অনেক ফলপ্রসূ হবে।
শহরের চেকপোস্ট এলাকার চায়ের দোকানি মিজানুর রহমান বলেন, চারপাশে মশা আর মশা। বিকেলের শেষভাগে উপদ্রব বাড়তে থাকে। রাত হলে চরম উৎপাত শুরু হয়। শুধু রাতে নয় দিনের বেলাতেও মশা কামড়ায় বলে দোকানে গ্লোব (মশার কয়েল) জ্বালিয়ে রাখি।
যশোর পৌরপার্কে প্রতিদিন হাঁটতে আসেন স্কুল শিক্ষক নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, হাঁটার সময়ও মশা কামড়ায়। হাঁটা শেষ করে পার্কের বেঞ্চিতে যখন বসি মনে হয় মশারা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পার্কের দর্শনার্থীদের সাথে আলাপচারিতায় সিনথিয়া জামান, আবিদুর রহমানসহ আরো কয়েকজন জানান- পার্কের কোথাও শান্তিতে একদন্ড বসবে কেউ তার উপায় নেই। দলবেধে এসে কামড়াতে থাকে মশারা।
যশোর মশার প্রার্দুভাব নিয়ে আলপচারিতায় যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা বলেছেন, শুধুমাত্র নিধনে অভিযানে নামলেই মশা কমে যাবে ব্যাপারটি কিন্তু সেরকম নয়। এক্ষেত্রে তাদের ভাষ্য হলো, মশক নিধনে কীটনাশকের ‘ল্যাথাল ডোজ’ (মারণ মাত্রা) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মাত্রা সঠিক না হলে মশারা মরে না। পাশাপাশি এটিও পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে চারপাশে লার্ভা (শুককীট) বা অ্যাডাল্ট (পূর্ণবয়স্ক) কোনটির পরিমাণ বর্তমানে বেশি। সেটি নির্ণয় করে অভিযানে নামতে হবে। এছাড়াও তাদের অভিমত, এখন গরমের শুরু। আর শুরুর এই সময়টাতে মশার প্রজনন শুরু হয়। তাই এখনই মশক নিধনের কার্যকর ও উপযুক্ত সময়। এই সময়টাতে নিধন চালানো গেলে বছরভর উপদ্রব কম থাকবে।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহসীন উদ্দিন মনে করেন, মশক নিধনের ক্ষেত্রে অনেক সময় কীটনাশকের ‘ল্যাথাল ডোজ’ বা মারণ মাত্রার সঠিক ব্যবহার হয় না। এতে মশারা না মরে উল্টো কীটনাশক ‘রেজিসট্যান্স’ (সহনশীল) হয়ে যায়। তিনি জানান, নিধন কার্যক্রমের আগে ও পরে মশার ঘনত্ব পরিমাপ করে দেখা দরকার। তাহলে মশার মারায় ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা ও সঠিক মাত্রাও বোঝা যাবে। এছাড়া চারপাশে লার্ভিসাইড (শুককীট) নাকি আডাল্টিসাইড (পূর্ণবয়স্ক) বেশি সেটি লক্ষ রেখে ওষুধ দিতে হবে। কারণ দুটি ধরণের জন্য ওষুধ ও মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন।
তবে শিগগিরিই মশা নিধনে নামতে যাচ্ছে যশোর পৌরসভা। এমন দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ডু বলেন, দ্রুতই মশক নিধন শুরু হতে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে পৌর পরিষদে আলোচনাও হয়েছে।
যশোরের সিভিল সার্জন বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস জানান, জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর মশার উপদ্রব। আর সবার মত তার বাড়িতেও এটির উপদ্রব বেড়েছে। শিগগিরিই দাপ্তরিকভাবে পৌর কর্তৃপক্ষকে মশক নিধনের অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেবেন।