কল্যাণ ডেস্ক
কুষ্টিয়া শহরতলীর জুগিয়া দরগাতলা এলাকার গড়াই নদী পাড় সংলগ্ন সবজি ক্ষেতে দেওয়া জালের বেড়ায় আটকে পড়েছিল বিষধর রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ। গত ৩০ জুন সেখানে সাপটিকে আটকে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। পরে স্থানীয় এক যুবক বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশন (বিবিসিএফ) টিমকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বিবিসিএফ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সাপটিকে উদ্ধার করে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। তার আগে গত বছর গড়াই নদীতে জেলেদের জালসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সাতটি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করা হয়।
বিষধর এই রাসেলস ভাইপার সাপ এখন আতঙ্ক ছড়িয়েছে কুষ্টিয়ার পদ্মা ও গড়াই পাড়ের মানুষের মধ্যে। জেলের জালে কিংবা লোকালয়ে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলছে সাপটির। এতে নদীপাড়ের মানুষের নির্ঘুম ও আতঙ্কে রাত দিন কাটছে। বিষাক্ত এই সাপের ছোবলে এর আগে মারাও গেছেন অনেকে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে পানির তোড়ে বাংলাদেশে ভেসে আসছে এসব বিষাক্ত সাপ।
নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানায়, পদ্মা ও গড়াই পাড়ে রাসেলস ভাইপার নামে এই বিষাক্ত সাপ মাঝে মধ্যেই মিলছে। কখনও জেলের জালে কখনো আবার চর কিংবা লোকালয়ে মিলছে। এর আগে নদীপাড়ের মানুষ বিরল প্রজাতির এই সাপ দেখেনি। বর্তমানে হরহামেশাই মিলছে এই সাপের অস্তিত্ব।
গত ৩ জুলাই রাজবাড়ীর পাংশায় পাটক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত হন কৃষক জাহিদ প্রামাণিক।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাটক্ষেতে নিড়ানি দেওয়ার সময় জাহিদ প্রামাণিককে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ছোবল দেয় বিষধর রাসেলস ভাইপার। সাপটিকে মেরে ফেলেন তিনি। জাহিদের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার হাবাসপুর চরপাড়া গ্রামে। এরপর তিনি চলে যান স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাপটিকে বিষধর রাসেলস ভাইপার বলে শনাক্ত করেন। সেখান থেকে জাহিদকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
জাহিদ প্রামাণিকের বাড়ি থেকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের দূরত্ব ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার। পাংশা থেকে তিনি বাসে করে কুষ্টিয়া যান। বেলা ১১টায় তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এ সময় তার সঙ্গে পলিথিনের ভেতর মরা সাপটি ছিল।
হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ‘রাসেলস ভাইপার সাপটি খুবই ছোট। সাপটির পেট বেশ ফোলা ছিল বলে ধারণা করা হয়, ছোবল দেওয়ার আগে সাপটি কিছু খেয়েছিল। এ জন্য হয়তো বিষ নাও থাকতে পারে। রোগীকে ভ্যাকসিন (অ্যান্টি ভেনম) দেওয়া হয়েছে।’
বুধবার (৫ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জাহিদ মেডিসিন (পুরুষ) ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বিছানায় আছেন। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে। আগের থেকে শারিরীকভাবে তিনি ভালো আছেন।
বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এস আই সোহেল জানান, অনেকটা অজগরের মত দেখতে সাপগুলো কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে যেন কৌতুহল আর গবেষণার শেষ নেই। এখন পর্যন্ত বিবিসিএফ টিম কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে ৭টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করেছে। বিশ্বের বিষধর সাপের যে সব প্রজাতি তালিকাতে রয়েছে তাদের মধ্যে রাসেলস ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম। এ সাপ নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত পরিবেশে এবং কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। অন্যান্য সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে রাসেলস ভাইপার সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। এরা প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা যায়। অন্যান্য সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও এ সাপটির স্বভাব ঠিক তার উল্টো। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। রাসেলস ভাইপারের বিষ হোমটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়। মাত্র ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে কাউকে কামড়ে বিষ ঢালতে পারে সাপটি। কামড়ের ক্ষিপ্রগতির দিক দিয়ে সব সাপকে হারিয়ে রাসেলস ভাইপার প্রথম স্থান দখল করেছে।
এ বিষয়ে ‘মানুষ মানুষের জন্য, কুষ্টিয়া’ নামক সংগঠনের সভাপতি শাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপগুলো উদ্ধার করে তা বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা সেগুলো লোকালয় থেকে দুরে অবমুক্ত করে দেন। প্রতিটি বন্যপ্রাণী প্রকৃতির ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখে যা অনেক মানুষের অজানা। তাই এদেরকে বাঁচাতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. জহুরুল ইসলাম জানান, এই সাপ ভারত থেকে বর্ষা মৌসুমে পানির তোড়ে ভেসে আসছে বাংলাদেশের পদ্মায়। যা ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মাসহ বিভিন্ন শাখা নদীতে। রাসেলস ভাইপার সাপ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দুর্লভ সাপ। এটি পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ পাওয়া গেলেও বর্তমানে এরা পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলা ও চরগুলোতেও বিস্তার লাভ করেছে। এতে আতঙ্ক বেড়েছে কুষ্টিয়ায়।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, এই সাপ অত্যন্ত বিষধর। যার কামড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তবে এর প্রতিষেধক রয়েছে। সময়মত চিকিৎসা নিলে বাঁচা সম্ভব।