শেখ সেকেন্দার আলী, পাইকগাছা
খুলনার পাইকগাছার বিভিন্ন নদীতে ভেসে আসা হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে সব বয়সের নারী-পুরুষ। সেই সাথে জীবন সংগ্রামে সংসারের বোঝা টানতে নদী থেকে পোনা আহরণের পর রাতে সেই পোনা পৌঁছে দিচ্ছে মৎস্য ঘেরে। নদীতে ভেসে আসা ‘হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে অভাবের সংসারে কিছুটা হলেও আনন্দ ফেরে পরিবারগুলোতে। তবে রেণু পোনা আহরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ আইনত নিষিদ্ধ আছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞার কথা জেনেও তারা এসব রেণু পোনা ধরেন। কেননা এই পোনা বিক্রি করেই কোনোরকমে সংসার চালাতে হয় তাদের। নদীতে অনেক নারী-পুরুষকে পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানছেন। নদী থেকে উজানে ভেসে আসা বাগদা ও গলদার রেণু পোনা ধরার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ নেট দিয়ে তৈরি করা একধরনের জাল পেতে অপেক্ষা করছেন। কেউ নদী তীরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জাল টেনেই চলেছেন। কেউ আবার নৌকায় বসে মাঝনদীতে জাল পেতেছেন। জালে আটকে পড়া ক্ষুদ্রাকৃতির গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে নদীর চরে রাখা গামলাতে উঠিয়ে রাখছেন।
কপোতাক্ষ ও শিবসা নদীর তীর ঘুরে পোনা আহরণকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংসারে অভাব অনটনের কারণে বিকল্প আয়ের পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ীর পোনা আহরণ করছেন। প্রতিদিন নদীতে ভাটার সময় ছোট জাল দিয়ে বাগদার পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ করেন। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে যে অর্থ পান তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। গোনমুখে ভাটার সময় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার চিংড়ি পোনা আহরণ করেন। পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন নদীতে শত শত নারী-পুরুষ চিংড়ি পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তারা মনে করেন, নদী থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ রাখতে হলে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করতে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেক পরিবারে অভিভাবকশূন্য পরিবারটির সব দায়িত্ব পড়ে যাচ্ছে নারীর উপর। ফলে দিন দিন তাদের পারিবারিক বন্ধন ক্ষীণ হতে থাকে। তাছাড়া অনেকে সময়মতো সংসারের খরচ পাঠাতে পারে না। এতে বাড়িতে থাকা নারীকে সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। আবার অনেক বিধবা নারীর পরিবারে উপার্জন করার মতো কোন লোক না থাকাই সমস্ত দায়িত্ব ঐ নারীকেই নিতে হচ্ছে। নারীর দায়িত্ব তখন সংসার সামলানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন ধারনের জন্য অর্থ উপার্জন করার দায়িত্ব ওই নারীকেই নিতে হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় তাকে। ফলে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আর নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার কারণে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। পুরুষ শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গেলেও বেশির ভাগ সময় নারী শ্রমিকরা বাড়িতে বেকার পড়ে থাকেন। অর্থ উপার্জনের বিকল্প কোন পথ না থাকায় নারীরা তখন বাধ্য হচ্ছেন নদীতে মাছের রেনু পোনা সংগ্রহ করতে।
শিবসা নদীতে রেণু পোনা সংগ্রহ করতে আসা রবিউল, বারিক, কামরুল, সখিনা বেগম, আকলিমারা জানান, অনেক সময় ভোর রাতে নদীতে জাল টানতে গেলে খুব ভয় লাগে। নদীতে কামট, কুমোর, সাপ, সোস থাকে আবার হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন তখন ঝড় উঠতে পারে যে কোন মুহুর্তে বিপদ আসতে পারে। তাছাড়া নদীর পানির ভিতর সবুজ রঙ্গের কিরাল সাপ (সাপটি লম্বা হয় ৩/৪ ফুট এবং চওড়া হয় ২/৩ ইঞ্চি) থাকে কামড় দিলে মানুষ বাঁচে না। শুধু সংসার চালাতে ভয়ডর বাদ দিয়ে নদীতে পোনা ধরতে নামতে হচ্ছে।
শামুকপোতা গ্রামের বিধবা নারী নুরনাহার (৪৮) বলেন, ‘হ্যাচারীর মালিকরা সাগর থেকে মা মাছ ধরে নিচ্ছে এবং তাছাড়া নদী মরে যাচ্ছে। তাই সাগর থেকে মাছ উপরের দিকে আসতে পারছে না। যে কারণে নদীতে মাছ ও পোনা কম পড়ছে। তাছাড়া নদীতে জেলের সংখ্যা ও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যদি ১০ জন জাল টানতো কিন্তু বর্তমানে ১০০ জন জাল টানছে। তিনি আরো জানান, জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও চুরি করে আমরা পোনা আহরণ করছি। পাইকগাছা নাগরিক বাস্তবায়ন উপ কমিটির উপদেষ্টা এড প্রশান্ত কুমার মন্ডল জানান, বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় মাছ শিকারই তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তাই অবৈধ জেনেও উপকূলের প্রায় হাজার হাজার হাজার মানুষ জীবিকার তাগিদে রেণু পোনা ধরেন। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে মৎস্য বিভাগ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান হয়, তখন তাদের জরিমানা বা গ্রেপ্তার হতে হয়। তবে পেটের তাগিদে আবারও এ কাজ শুরু করে তারা।