এজাজ কায়েস, খুলনা ব্যুরো
গত ৩০ বছর লবণ পানি ও চিংড়ি চাষের বিরূপ প্রভাবে খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে ৬০ প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি। চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। গাছ-পালা না থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ হুমকির মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র্য। কর্মসংস্থানের অভাবে গত এক দশকে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে হাজার হাজার শ্রমজীবী। চিংড়ি বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি।
এক সময়ের কৃষি অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার নদ-নদীগুলোতে ষাটের দশকে তৎকালীন সরকার ওয়াপদার ভেড়ি বাঁধ নির্মাণ করলে এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে বিল্পব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্য। প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। কালের বিবর্তনে ৮০’র দশকে এ অঞ্চলের কৃষি জমিতে লবণ পানি উত্তোলন করে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী চিংড়ি চাষ। প্রথম দিকে ধান এবং মাছের উৎপাদন ভাল হওয়ায় এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি প্রভাবশালী ঘের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং এসব ঘের মালিকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় ধান চাষ বন্ধ করে জমিতে সারা বছর লবণ পানি ধরে রেখে শুধুমাত্র চিংড়ি চাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, মংলায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। প্রভাবশালী ঘের মালিকরা এসব চিংড়ি ঘেরে ধান চাষের সুযোগ না দেয়ায় বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারী কৃষকরা। দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিপত্রের কারণে ভিন্ন আয়ের উৎস না থাকায় কয়েক বছরের হারির টাকা অগ্রিম নিয়ে খরচ করে অভাব অনটনের কারণে অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার তাদের জায়গা জমি বিক্রি করে ভূমিহীন হয়েছেন। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। কর্মসংস্থানের অভাবে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। অপরদিকে একই জমিতে দীর্ঘদিন চিংড়ি চাষের ফলে মাটি ও পানির সকল গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় চিংড়িতে দেখা দিয়েছে ভাইরাসসহ নানাবিধ রোগ বালাই।
আরও পড়ুন:যশোরে অপ্রতুল বরাদ্দ ওএমএস’র পণ্যের
সম্প্রতি ভাইরাসের কারণে বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত না আসায় ঋণগ্রস্থ হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক চিংড়ি চাষি। এছাড়াও লবণ পানির প্রভাবে ধান চাষ ব্যাহত হওয়ায় গত দু’দশক ধরে এ অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পরিবেশের উপর। আভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও পানি নিস্কাশনের সরকারি খালগুলো বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে পলি পড়ে অধিকাংশ নদ-নদী ও খাল ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। চলতি বছর সাতক্ষীরাসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা স্থায়ি জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ওয়াপদার ভেড়ি বাঁধ কেটে ঘেরের পানি সরবরাহের স্লুইস গেট নির্মাণ করায় ৬০’র দশকে নির্মিত পুরানো বাঁধগুলো অসংখ্যা জায়গা নিচু ও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ফলে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের উপচে পড়া পানি ভিতরে প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্রভাবিত হয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। বিচরণ ক্ষেত্র ও গো-খাদ্যের অভাবে এ অঞ্চলের মানুষ, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া লালন-পালন ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। গাছ-পালা নেই বললেই চলে। ফলে চরম জ্বালানী সংকট দেখা দিয়েছে। আবাসস্থলের অভাবে ময়না, টিয়া, দোয়েল, শ্যামা, ঘুঘু শালিকসহ অসংখ্য পাখি, বন্য প্রাণী ও অনেক উভচর প্রাণী এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত প্রায়। কমেছে প্রাকৃতিক উৎসে মাছের উপস্থিতি। বিলুপ্ত হয়েছে শোল, টাকি, বাইম, মলা, চেলা, দাড়কিনাসহ ৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হুমকির মুখে পড়বে উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র।
খুলনা জেলা কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বছরের পর বছর উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি জমি লবণ পানিতে তলিয়ে রাখায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ফসলের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসবে।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের উর্দ্ধতন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান নীলুফা বেগম বলেন, গত তিন দশকে লবণ পানির প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। তিনি আর বলেন এ অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরগুলো সনাতন পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন চাষাবাদের ফলে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং পচনশীল বস্তু মাটিতে মিশে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উর্বরা শক্তি কমে যাওয়ায় পানির তলদেশে শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে চিংড়ির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে সনাতন পদ্ধতিতে নির্ভরশীল না হয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন:বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ যশোরের ডিসির