সরকারি অনুদানই লক্ষ্য
অধিকাংশ পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই
থাকে তালাবদ্ধ
নেই পাঠক
তবিবর রহমান: যশোর শহরের পূর্ব বারান্দীপাড়ার অধ্যাপিকা শামসুন নাহার গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৮ সালে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ধরে গত এক সপ্তাহ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অস্তিত্ব মেলেনি। সর্বশেষ সম্পাদক মামুন সারওয়ারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করলে তিনি দিলেন অবাক করা তথ্য। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি তো চালু করার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিচালনা করার মতো কেউ না থাকায় তিনি বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকায় চলে যান।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লাইব্রেরিটা এখনো যশোর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের নিবন্ধনভুক্ত হিসেবে চালু রয়েছে। সরকারি গণগ্রন্থাগার যশোর থেকে ২০১৩ সালে গণগ্রšা’গার অধিদপ্তরে পাঠানো তথ্যেও তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি অনুদান তুলে নেয়ারও তথ্য মিলেছে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে প্রাপ্ত তথ্যে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
যশোরের শার্শার পাকশিয়ায় ঠিকানা দেয়া আছে ‘চেতনা পাঠাগার’র। ঘর ভাড়া নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে লাইব্রেরিটি চালু রয়েছে বলে সরকারি গণগ্রন্থাগার যশোরের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। যশোর সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে ২০১৩ সালে বেসরকারি লাইব্রেরির যে হালনাগাদ তালিকা করা হয়েছে সেখানে সভাপতি/সম্পাদকের নাম রয়েছে বজলুর রহমান। কিন্তু চেতনা পাঠাগারের অস্তিত্ব জানান দিতে পারেননি ওই এলাকার বিশিষ্টজনেরা। ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ আমিরুল আলম খান বলেন, পাকশিয়ায় চেতনা পাঠাগারের নাম কখনো শোনেননি। পাকশিয়াতে বেড়ে উঠেছেন যশোরের সাংবাদিক সাজেদ রহমান বকুল। তিনিও চেতনা পাঠাগারের নাম শোনেননি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি বেসরকারি অনুদান তোলা হয়েছে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বইপড়া প্রবন্ধে লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের উপরে স্থান দিয়েছেন। এজন্য তিনি নগরে নগরে নয়; গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য জোর দেন। প্রথম চৌধুরীর সেই আহবানে সাড়া দিয়েই হয়তো যশোরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত রয়েছে ৫৭টির। কিন্তু এসব লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার পাঠক টানতে পারছে না। কারও স্মৃতি রক্ষায়, কেউ বা অনুদানের আশায়, আবার কেউ কেউ বাণিজ্যিক বিবেচনায় লাইব্রেরি গড়ে তুলছেন। ফলে পাঠকরা গণগ্রন্থাগারমুখী হচ্ছে না। পাঠককদের অভিযোগ বেশিরভাগ সময় গণগ্রন্থাগারগুলোতে তালা ঝোলে। ইচ্ছেমতো খোলা হয়। অনুদান পেতে যে বই ও পাঠকের সংখ্যা দেখানো হয় তা বাস্তবতার সাথে ঢের ফাঁরাক।
গতকাল বিকালে শহরের ষষ্ঠীতলাস্থ পিটিআই রোডে সাজ লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। যশোর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের ৩৭ নম্বরের নিবন্ধনভুক্ত এই লাইব্রেরির সত্ত্বাধিকারী আক্তারুজ্জামান। নিজ বাড়ির নিচতলায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করলেও পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারেনি। আক্তারুজ্জামান নিজেই বললেন, প্রতিদিন ২/৪ জন মতো পাঠক আসে।
বাঘারপাড়ার ঘুনি (ঘোষনগর) গ্রামে অরূপ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। স্থানীয় হরিদাসের ছেলে অরূপ মারা যাওয়ার পর তার নামেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে। নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে অনুদান। গ্রন্থাগারিক সুকুমার দেবনাথ জানান, বর্তমান প্রজন্ম মুঠোফোনে আকৃষ্ট। এজন্য পাঠক কমে যাচ্ছে। এরপরও প্রতিদিন বিকেলে তারা লাইব্রেরিটি খুলে থাকেন।
অভয়নগরের নওয়াপাড়ার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, তারাও কোন রকম টিকে আছেন। গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ জন পাঠক আসেন। তবে যশোর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের হিসেবে এই লাইব্রেরিতে পাঠকের গড় উপস্থিতি ২৫ জন। রাখা হয় দৈনিক তিনটি পত্রিকা। এসব তথ্য উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের নামে অনুদান সংগ্রহ করা হয়।
যশোর শহরের নীল রতন ধর রোডের চার খাম্বা মোড়ের ঠিকানা ব্যবহার করে ২০১০ সালে নিবন্ধন নিয়েছে ছায়া পাঠাগার। যশোর সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে বেসরকারি লাইব্রেরির যে হালনাগাদ তালিকা করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে পাঠকের উপস্থিতি গড় ২১ ভাগ। অথচ সেখানে ছায়া পাঠাগারের অস্তিত্ব মেলেনি। অনেক তথ্য অনুসন্ধানের পর জানা গেল ছায়া পাঠাগার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক মহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কার্যক্রম এখন আইটি পার্কে। সেভাবে আর লাইব্রেরি চালানো হয় না। বই এখন বান্ডিল করা। শহরের পুরাতন কসবা কাজীপাড়ায় রয়েছে রাইজ গ্রন্থগার। যশোর সরকারি গণগ্রন্থাগারের তথ্য মতে সেখানে পাঠকের গড় উপস্থিতি ৬০ ভাগ। কিন্তু সেখানে কোন পাঠকই যায় না। প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক শরীফুল আলম মারা গেছেন। তার স্ত্রী নিলুফা বেগম এখন দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, তার ছেলের বন্ধুরা এখানে পড়াশোনা করে। এসএসসি পরীক্ষার কারণে আপাতত তারা পড়তে আসছে না।
ডা. আবুল কাশেম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের বৃহত্তর যশোর জেলায় ২০টি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে। এরমধ্যে জেলা শহরের লোন অফিস পাড়া, বাগমারাপাড়া ও বাঘারপাড়ায় তিনটি লাইব্রেরি রয়েছে। এ লাইব্রেরিগুলোতে পাঠকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। গতকাল সন্ধ্যায় শহরের বাগমারাপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে লাইব্রেরিটি তালাবদ্ধ রয়েছে।
এবিষয়ে যশোর সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান মমতাজ খাতুন বলেন, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত রয়েছে ৫৭টি। অনুদানের জন্য যাচাই বাছাই করা হয়। যেসব লাইব্রেরি সক্রিয় আছে এমন ২১টি প্রতিষ্ঠানকে অনুদানের জন্য চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। অন্যদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।