নিজস্ব প্রতিবেদক
‘একজন তুলে ধরেন তাওহিদের গুরুত্ব, আরেকজন সুরে সুরে আহ্বান করেন প্রেমসাগরে ডুব দিতে। শরিয়ত ও মারফতের পক্ষে-বিপক্ষে জমে ওঠে যুক্তিতর্ক। আসতে থাকে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। নারী-পুরুষের দুই পালাকারের ঘণ্টাব্যাপী বাহাসের পর চিন্তায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা রেখেও একসঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপনের তাগিদ দেয় উভয় পক্ষ। কারণ বৈচিত্র্যই সৃষ্টির সৌন্দর্য।
বুধবার রাতে যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে বসেছিল পালাগানের এ আসর। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তুলে ধরতে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় শিল্প নিয়ে পৌঁছে যাব আমরা উন্নতির শিখরে এই প্রতিপাদ্য নিয়ে পালাগানের জমজমাট আসর হয়। গণজাগরণের শিল্প আন্দোলনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে সারা দেশেই এই পালাগান হচ্ছে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। পালাগান পরিবেশন করেন ইউসুফ বয়াতি ও ডলি সরকার’র দল। পালার নাম ছিল শরিয়ত-মারিফত। পালাগানের বাণী ও সুরে মোহিত হয় আগত দর্শকশ্রোতা। যদিও এদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারণে দর্শকের উপস্থিতি ছিলো কম।
প্রথমে নানা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে পৃথক দুটি দেশত্মবোধক গানের সুরে এই পালা শুরু করে দু-দলই। ঢোল-সেতারা, বাঁশি মনোমুগ্ধকর সুরে প্রথমেই মুগ্ধ করে তোলে দর্শকদের। পালাটি ছিল শরিয়ত ও মারফতের। এতে শরিয়তের পক্ষে আখ্যান নির্মাণ ও যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন বাউল ইউসুফ বয়াতি। তার বিপক্ষে মারিফতে ছিলেন বাউল ডলি সরকার। ওলি-আউলিয়া, গাউস-কুতুবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করেন ইউসুফ বয়াতি। অনন্ত অসীম প্রেমময় স্রষ্টার বন্দনা করেন শুরুতে। ভূমিকা শেষ হলে ধীরে ধীরে মূল পর্বে প্রবেশ করেন এই মারফতের ফকির। শরিয়তের আলেমের কাছে তিনি প্রশ্ন রাখেন- ‘নামাজ পড়লে নামাজি, রোজা রাখলে রোজাদার, হজ করলে হাজি এবং জাকাত দিলে মানুষের পরিচয় হয় দাতা। কী করলে মানুষ তবে ‘মুসলমান’ হয়? পালাকার বাউল ডলি সরকার নিজের পর্বের শুরুতেই উত্তরটা দিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘তাওহিদের পথে থেকে যে আত্মশুদ্ধি করে সে-ই মুসলমান। স্কুল-কলেজ থেকে নিয়ে চারপাশের সব কিছুতেই রয়েছে শরিয়তের উপস্থিতি। শরিয়তের বাইরের যা তা ইসলাম নয়। ইউসুফ বয়াতি বলেন, ‘মারফতের সব তরিকার প্রধানরাও ছিলেন শরিয়ত মান্য করা হক্কানি আলেম। কাজেই মারফতের সব ভেদ রয়েছে শরিয়তের মাঝেই। এমনতর দার্শনিক জিজ্ঞাসা, উত্তর-প্রতিউত্তরের ফাঁকে ফাঁকে দুই পালাকারই মূলত ইসলাম ধর্মের গুণগান গাইতে থাকেন। এর মাঝে আকর্ষণীয়ভাবে তারা উপস্থাপন করেন মহানবী (সা.)-এর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও তার আদর্শ জীবনের গল্প। দুই পালাকারের সঙ্গে হারমোনিয়াম, দোতারা, বাঁশিসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সংগত দেয় দুটি পৃথক দল। তত্ত্ব ব্যাখ্যা, শ্লোক ও দীর্ঘ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই পালা।
এর আগে যশোর শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলুর সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন অর রশিদ, উদীচি যশোর সংসদের সাধারণ সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব, ইউসুফ বয়াতি ও ডলি সরকার। পালাকার ইউসুফ বয়াতি বলেন, ‘শরিয়তের আলেম ও মারফতের ফকিরের বিতর্ক সুদূর অতীত কাল থেকেই চলছে। তবে পালা ও বিতর্কের সৌন্দর্য হলো ভিন্নমত নিয়েও সহাবস্থান করতে শেখা। সুফি-সাধকদের পালাগান-কবিগান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শিল্পকলা সেই হারিয়ে যাওয়া পালাগান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ধরণের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। যশোর শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু বলেন, ‘পালাকাররা একেকজন দার্শনিক। তারা দর্শনের কথা বলেন। পালাগান বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। বর্তমানে পালাগানের ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে। সেই বিষয়টিকে অনুধাবন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে সারা দেশে পালাগানের আসর হচ্ছে। সাংস্কৃতি কর্মী ও সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক দিন পর পালা শুনলাম। খুব ভালো লেগেছে। বাঙালী সংস্কৃতির প্রাচীন এই শিল্প মাধ্যম হারাতে বসেছে। গ্রাম গঞ্জে শরিয়ত-মারফত পালা পাওয়া বয়াতি ও বাউল শিল্পীদের উপরে উগ্রবাদীরা হামলা করছে। এজন্যে শিল্পীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাউল বয়াতিদের নিয়ে গ্রামের বটতলায় বটতলায় এই সব গানের আসর বসাতে হবে। তাহলেই বিঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটবে। একই সাথে অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে।’