নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরের তানযীমুল উম্মাহ প্রি-হিফয মাদরাসার এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের আলোচনার মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে হঠাৎ করা এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে ঘটনাকে পুঁজি করে তাদের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল এবং গণমাধ্যমে ‘ভিত্তিহীন অপপ্রচার’ চালানো হয়েছে। তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীর অভিভাবক এসব অভিযোগকে মনগড়া দাবি করে বলেছেন ঘটনার দায় এড়াতেই নতুন করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
১২ নভেম্বর সকালে মাদরাসার এক শাখায় হিফয শিক্ষক আব্দুস সামীরের আচরণে রাইয়ান নামে এক শিক্ষার্থী আহত হয়। ঘটনার পরপরই শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং পরে শিক্ষক আব্দুস সামীরকে সাময়িক বরখাস্তের পর স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা ঘটনাস্থলে যান এবং অভিভাবক, প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও কোতোয়ালি থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে খবর প্রকাশ করেন। বেশ কিছু প্রতিবেদনে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও ‘টর্চার সেল’-এর মতো অভিযোগ উঠে আসে।
ঘটনার কয়েকদিন পর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ লিখিত বিবৃতিতে দাবি করে, রাইয়ান অসাবধানতাবশত পড়ে গিয়ে হালকা আঘাত পেয়েছিল, তার হাতে কোনো ভাঙন ছিল না এবং অভিভাবক ও তৃতীয় পক্ষ মিলে প্রতিষ্ঠানের কাছে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, টাকা না দেওয়ায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হয়েছে। বিবৃতির সঙ্গে একটি মেডিকেল রিপোর্টও পাঠানো হয়, যেখানে শিক্ষার্থীর হাতে ভাঙন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীর বাবা রাসেল আহমেদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমাকে কোটি টাকা দিলেও মীমাংসা করব না। আমি বিচার চাই।” তিনি দাবি করেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ প্রথমে তার সন্তানের পড়াশোনার ব্যয় মওকুফের প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হননি। তিনি সন্তানের ভবিষ্যৎ ও মানসিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে ঘটনাটি প্রথমে শান্তভাবে মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। অভিভাবক হিসেবে তিনি মাদ্রাসার সঙ্গে আলোচনার সময় কিছু আনুমানিক হিসাব নিয়ে কথা বলেছিলেন—শিশুটির চিকিৎসা, কাউন্সিলিং, পড়াশোনার ক্ষতি ইত্যাদি বিবেচনায় একটি মানবিক সমাধান চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: সাভার স্মৃতিসৌধে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন
কিন্তু সেই কথাকেই এখন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ‘চাঁদা দাবি’ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে নির্যাতনকারীর অপরাধকে আড়াল করতে চাইছে এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
এরপরই মাদরাসার পক্ষ থেকে তাকে ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই বিবৃতি বিষয় তিনি যশোর কোতোয়ালি থানায় জানিয়েছেন।
বরখাস্ত হওয়া শাখা প্রধান সাইফুর রহমান দাবি করেন, ঘটনাটি বড় করে দেখানোর পেছনে পিয়াল ও মাহমুদ নামের দুই ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে। রাসেল আহমেদ এ দাবি নাকচ করে বলেন, তারা তার আত্মীয় এবং শিশুটির খোঁজ নিতে মাত্রই সেখানে গিয়েছিলেন।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলেন, ঘটনাটির পরপরই পুলিশ ও অভিভাবকদের তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা বলেন, “শিক্ষককে বহিষ্কার করা ও শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠান স্বীকার করেছে। অথচ এখন গণমাধ্যমকেই দায়ী করা হয়েছে—এটি অযৌক্তিক।” সাংবাদিকরা মনে করেন, পুরো ঘটনাকে অন্যদিকে ঘোরাতে এবং নির্যাতনের অভিযোগকে দুর্বল করতে গণমাধ্যমকে জীবাণুর মতো ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষক শিশু শিক্ষার্থীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে। দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষককে আটক করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এখন ওই শিক্ষককে ‘নির্দোষ’ দাবি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছে। এতে নতুন করে চাপে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবার।
কোতোয়ালি থানার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া এবং শিক্ষককে বরখাস্ত করার বিষয়টি সত্য। অভিভাবক ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষের অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং ঘটনাটির তদন্ত চলছে। তদন্তে চাঁদা দাবির অভিযোগসহ সব দিক যাচাই করা হবে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে অপরাধ আড়াল করতে দিতে থাকলে অন্য শিশুদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাবে। তারা সুষ্ঠু তদন্ত, নির্যাতনকারী শিক্ষকের বিচার এবং মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয়দের মতে, প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বিবৃতি ও অভিভাবকের পাল্টা অভিযোগে ঘটনাটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। নির্যাতন ঘটনার পর শিক্ষক বহিষ্কার, আবার একই ঘটনায় চাঁদা দাবির অভিযোগ—এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশি তদন্তেই প্রকৃত সত্য পরিষ্কার হবে বলে তারা মনে করেন।
আরও পড়ুন: বাঘারপাড়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান-মেয়র ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২১ জনের নামে মামলা
