রেজওয়ান বাপ্পী
কাঠ ও কংক্রিট দিয়ে উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে ২২টি বেড। প্রতিটি বেড ৪ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি দিয়ে ভরাট করা। তাতে লাগানো হয়েছে লাউ, শিম, কুমড়া, বরবটি, বাঁধাকপি, পেঁপে, কাঁচা মরিচসহ ২২ ধরনের সবজি। শুধু সবজি নয়, এই চার ইঞ্চি বেডেই রোপণ করা হয়েছে পেয়ারা, জলপাইসহ নানা রকমের ফলদ গাছ। এগুলো থেকে সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি ফল সংগ্রহ করা হচ্ছে নিয়মিত। যা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বাজারে।
বলছিলাম যশোর সদর উপজেলার হামিদপুরের বাসিন্দা কৃষিবিদ ইবাদ আলীর ছাদবাগানের কথা। তিনি নিজের ছাদে গবেষণার মাধ্যমে চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। নাম দিয়েছেন ‘শেকড় প্রযুক্তি’। তার এ সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতোমধ্যে আশপাশসহ সারা দেশে এ প্রযুক্তিতে প্রায় এক হাজার ছাদবাগান গড়ে উঠেছে। এই শেকড় প্রযুক্তিতে শুধু ছাদে নয়, জলাবদ্ধ এলাকা ও পরিত্যক্ত জমিতে চাষ করেও লাভবান হওয়া সম্ভব বলে দাবি প্রায় চার বছরের গবেষণায় সফল হওয়া এই কৃষিবিদের।
কৃষিবিদ ইবাদ আলী পেশায় সরকারি চাকরিজীবী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি শুধু গবেষক নন, বরং একজন স্বপ্নবুননকারী। স্থানীয় সরকার বিভাগের চাকরির ব্যস্ততা সামলে তিনি ছাদে, মাটিতে, আর বইয়ের পাতায় এক নতুন কৃষি দর্শন গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি তিনি শেকড় প্রযুক্তি নিয়ে একটি বইও লিখেছেন, যাতে ছাদকৃষি করতে ইচ্ছুক মানুষ সহজেই তার পদ্ধতি শিখে নিতে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইবাদ আলীর বাড়ির ছাদ যেন দিগন্তজোড়া সবজি ক্ষেতে পরিণত হয়েছে। মাচায় ঝুলছে লাউ, বরবটি ও কুমড়া। বাঁধাকপির পাতা বাঁধতে শুরু করেছে। ফলন হয়েছে কাঁচা মরিচের। নিজের উদ্ভাবিত শেকড় প্রযুক্তিতে ২২ ধরনের সবজি ও ফল চাষ করেছেন তিনি।
কৃষিবিদ ইবাদ আলী বলেন, গাছের শেকড়ই ফসলের প্রাণ। শেকড় বুঝতে পারলেই গাছকে বোঝা যায়। এই বিশ্বাস থেকেই এসেছে ‘শেকড় প্রযুক্তি’। এ পদ্ধতিতে গাছের শেকড়ের গঠন ও বিন্যাস অনুযায়ী মাটি, পানি, বায়ু, আলো ও খাবারের (সার) সঠিক ব্যবহার হয়। গাছ মাটির অগভীর অঞ্চল থেকে খাবার গ্রহণ করে। গাছ সাধারণত সমবায় পদ্ধতিতে খাবার গ্রহণ করে। কিছু গাছের শেকড় মাটির অগভীর অঞ্চল থেকে মূল রোমের মাধ্যমে খাবার নেয়। সাধারণত মূল রোমের সংখ্যা উৎপাদনের সমানুপাতিক। মূল রোমের সংখ্যা যত বেশি হবে, ফসল উৎপাদন তত বেড়ে যাবে। মূল রোমের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উপায় হলো পাশে স্পেস বা জায়গা বাড়ানো এবং পরিমিত খাবার, পানি সরবরাহ।
শেকড় প্রযুক্তির মূল কথা হলো- সবজি বীজ বা চারা বেডে রোপণ করতে হবে। ফলের চারা চ্যানেল সিস্টেমে রোপণ করতে হবে। ড্রামে বা টবে রোপণ করা যাবে না। সবজির জন্য মাটির গভীরতা ৪ ইঞ্চি হতে হবে (৬ ফুট বাই ৩ ফুট মাটির গভীরতা ৪ ইঞ্চি) এবং ফলের জন্য মাটির গভীরতা ১০ ইঞ্চি। ফলের টবের ব্যাস কমপক্ষে ৩ ফুট। ফর্মুলা অনুযায়ী মাটিতে সব ধরনের খাদ্যপ্রাণ মেশাতে হবে। পরিমিত সেচ নিয়মিত দিতে হবে। ফলের গাছে চ্যানেল আকারে রোপণ করতে হবে। যে গাছের শেকড়ের জন্য যতটুকু মাটি প্রয়োজন, সেই পরিমাণ মাটি ব্যবহার করতে হবে। একটুও কম বা বেশি নয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি বর্গফুট জায়গায় ১২ কেজি মাটি লাগে।
তিনি বলেন, ১৮ বর্গফুটের বেডে ৩ দশমিক ৫ বস্তা মাটি লাগে। যার ওজন ১৫৪ কেজি। একটি সাধারণ ড্রামের মাটির সমান। একই মাটি ব্যবহার করে ছাদে ১০ গুণ বেশি ফসল ফলানো সম্ভব। বেডগুলো সুন্দর করে সাজাতে পারলেই ছাদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। হাঁটার জন্য অনেক ফাঁকা জায়গা থাকে। পুষ্টির প্রায় ৯৫ শতাংশ আসে সবজি ও মসলা থেকে, যা ড্রামে বা টবে চাষ করা সম্ভব নয়। ড্রাম বা টব পদ্ধতিতে খরচ বেশি। সে অনুযায়ী উৎপাদন কম। শেকড় প্রযুক্তিতে ফল বা সবজি রোপণ করলে ফলন দ্বিগুণ হয়।
কৃষিবিদ ইবাদ আলী বলেন, গতানুগতিক ছাদ কৃষিতে লাভ কম, খরচ বেশি। আমার উদ্ভাবিত শেকড় প্রযুক্তিতে সাশ্রয়ী খরচে কম জায়গায় বেশি উৎপাদন হচ্ছে।
ইবাদ আলীর শেকর প্রযুক্তি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাদবাগান করা প্রতিবেশী খায়রুল ইসলাম বলেন, শেকড় প্রযুক্তিতে আমিও ছাদবাগান করেছি। পাশাপাশি টবেও সবজি লাগিয়েছিলাম। তবে ইবাদ আলী ভাইয়ের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে তুলনামূলক ভালো ফলন পেয়েছি।
ইবাদ আলীর স্ত্রী পাপিয়া সুলতানা বলেন, শেকড় পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবেও ছাদবাগান করা সম্ভব। এতে পরিবারের সবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়া যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ইবাদ আলী শেকড় প্রযুক্তিতে পরিকল্পিতভাবে বাড়ির ছাদে সবজি চাষ করেছেন। তার নতুন চাষ প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে কৃষিতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। যদি তার শেকড় প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে শহরেও মানুষ নিরাপদ ও পুষ্টিকর সবজি উৎপাদন করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, ভবদহের মতো জলাবদ্ধ এলাকাতেও ভাসমান শেডে এই পদ্ধতিতে চাষ সম্ভব। যে দেশ প্রতিদিন মাটি হারাচ্ছে নদী ও নগরায়ণের চাপে, সেখানে ইবাদ আলীর শেকড় প্রযুক্তি যেন এক নতুন আশার আলো।
