নিজস্ব প্রতিবেদক
সবার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা আবেগে সিক্ত হয়ে শেষ বিদায় নিয়েছেন যশোরের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনের প্রতিথযশা ব্যক্তিত্ব জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সুকুমার দাস। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে শহরের নীলগঞ্জ মহাশ্মাশানে ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতা শেষে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে সকালে ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয় সবার প্রিয় সুকুমার দাসকে। সেখানে জেলা প্রশাসন-পুলিশ প্রশাসন, স্বজন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানান তার অন্তিম যাত্রায়। শ্রদ্ধা জানাতে এসে সুধীজনেরা জানান, ‘বহুমাত্রিক’ এই সাংস্কৃতিক যোদ্ধার অকালে চলে যাওয়াতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। জীবনভর তার সততা আর নেতৃত্বের কারণে বেঁচে থাকবেন যশোরবাসীর হৃদয়ে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লড়াইয়ে দীপ্ত বলিয়ান সুকুমারের আদর্শকে সবাই ধারণ করলে দেশে হবে অসাম্প্রদায়িক। এদিকে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাসের মৃত্যতে শোক জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, যশোর-৩ আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, যশোর-৬ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার, যবিপ্রবির ভিসি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
গত ৫ এপ্রিল অসুস্থ হয়ে সুকুমার দাস যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এখানে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন তার হার্টে ব্লাক ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা তাকে খুলনায় রেফার করেন। খুলনা সিটি হাসপাতালে তার হার্টে একটা রিং পরানো হয়। চিকিৎসা নিয়ে ৯ এপ্রিল যশোরে ফিরে আসেন তিনি। যশোরে এসেই ওইদিনই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সন্ধ্যায় আবার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর সুস্থ হওয়ায় ১১ এপ্রিল দুুপুরে তাকে বাড়িতে নেয়া হয়। একদিন বাড়িতে থাকার পর বুধবার রাতে তিনি মারা যান। মৃত্যুর খবর শুনে সর্বস্তরের মানুষ হাসপাতালে ছুটে যান। পূর্বঘোষিত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে আনা হয় দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বাক্ষী হওয়া তার প্রিয় স্থান টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে। বেঁচে থাকতে তিনি বলেছিলেন এই মঞ্চে উঠলেই তিনি ফিরে পান তারুণ্য। তবে তিনি এবার এলেন নিথর দেহে। যেখানে যে মানুষটার নির্দেশনায় অনুষ্ঠিত হতো পুরো অনুষ্ঠান, আবার সেই মঞ্চে যার নেতৃত্বে গায়তো সববয়সী শিল্পীরা। এ জীবন পূণ্য করো দহন দানে, আগুণের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রাণে’ টাউন হল মাঠের রওশন আলী মঞ্চে সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক জোটের শিল্পীদের খালি গলায় শোক গীতি পরিবেশকে আরে বেশি আবেগী করে তোলে। অশ্রুসজল চোখের মতো শিল্পীদের কণ্ঠেও বেদনার সুর প্লাবিত করে উপস্থিত সকলের চোখের কোণা। এমন গানে তিনি জীবনে বহুবার নেতৃত্বে দিয়েছেন। আর আজ তিনিই এই গানের উপজীব্য। ময়দানে মরদেহ আসার আগে সকাল ৮টা থেকেই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনের প্রতিথযশা ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানোর জন্য ঢলনামে সবশ্রেণি মানুষের। টানা দেড় ঘণ্টা শ্রদ্ধা জানান প্রায় দুই শতাধিক সংগঠন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল। শ্রদ্ধা জানাতে এসে সবাই চোখে ছিলো অশ্রুসিক্ত। অনেককেই মরদেহের সামনে ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেছে। শ্রদ্ধা জানান প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যে। প্রিয় এই মানুষটাকে শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেননি যশোরের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান ও পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার। একে একে শ্রদ্ধা জানান নিজ হাতে গড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনশ্চ যশোর, দীর্ঘদিন নেতৃত্বে দেওয়া সাংস্কৃতিক সংগঠনের মেলবন্ধন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জান পিকুল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, সদর আসনের সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ পক্ষে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. প্রফেসর আহসান হাবিব, যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার, খুলনা বিভাগীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, জেলা বিএনপি, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগ, প্রেস ক্লাব যশোর, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক গ্রামের কাগজ, দৈনিক লোকসমাজ, দৈনিক স্পন্দন, দৈনিক রানার, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন যশোর জেলা শাখা, যশোর ইনস্টিটিউট, জেলা স্কুল, সুরধুনী যশোর, সুর নিকেতন, স্পন্দন, ভবের হাট, নৃত্য বিতন, তীর্যক যশোর, চারুতীর্থ, সৃষ্টিশীল সাহিত্য সংগীত একাডেমী, নন্দন যশোর, শিল্পকলা একাডেমি যশোর, বাউলিয়া সংঘ যশোর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কেশবপুর, নন্দন, সনাক, যশোর সাহিত্য পরিষদ, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, জয়তী সোসাইটি, বিবর্তন, চাঁদের হাট যশোর, নান্নু চৌধুরী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট, শেকড় যশোর, দোতলা সাহিত্য পরিষদ, বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদ, সুরবিতান, বিবর্তন ঝিকরগাছা, প্রথম আলো বন্ধু সভা, প্রত্যয় থিয়েটার, ক্যানভাস থিয়েটার, কিংসুক যশোর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঝিকরগাছা, উপশহর কলেজ যশোর, সুপ্তসুর যশোরসহ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক, সাামাজিক, রাজনৈতিক পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের হৃদয়ের অতল শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোর জেলার সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি দিপংকর দাস রতন বলেন, ‘মাত্র ৬৬ বছরের জীবনে সুকুমার দাস ৫৪ বছর সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগ্রামে ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটির চেতনায় ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সব সময় লড়াই করেছেন সত্য ও ন্যায়ের সঙ্গে। তার এই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানুষ তাকে স্বীকৃতি না দিলেও কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার এই অকালে চলে যাওয়া যশোরের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, ‘সুকুমার দাস ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক পথিকৃত। যশোরে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এই অকাল চলে যাওয়া যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সেই শোককে শক্তিতে রুপান্তিত করতে এবারের সকল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে সুকুমার দাসকে উৎসর্গ ও স্মৃতিতে। প্রতিটি সংগঠনই সুকুদার দাসের স্মৃতি ব্যানার নিয়ে এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান করবে।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান এক শোক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অধ্যাপক সুকুমার দাসের অকাল মৃত্যুতে যশোর জেলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হলো। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’
পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার এক শোকবার্তায় বলেন, যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিকাশের ক্ষেত্রে সুকুমার দাস অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ছিলেন। যশোরের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি সুকুমার দাসের অকাল প্রয়ানে শুধু যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন নয়, গোটা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি তার বিদেহী আত্মার অপার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
শোক জানিয়েছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগ, যশোর জেলা বিএনপি, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগ, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, উদীচী যশোরের সভাপতি তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য, জেলা মহিলা পরিষদসহ যশোরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
