নিজস্ব প্রতিবেদক
সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়াই শেষ হলো যশোরের ৮ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার কঠোর নিরাপত্তায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে যশোর সদর উপজেলায়। দুই-একটি স্থানে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ থাকলেও কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ফলে নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে আটটি উপজেলা নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ বলছেন ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২ বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রক্তপাত হলেও উপজেলা নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়নি।
এদিকে, গতকাল কোনো ঝামেলা ছাড়াই সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উপজেলার ২১৯টি ভোটকেন্দ্রে ভোগ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ উপজেলায় ৩৩ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
সরেজমিনে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল বেশি। ভোট দেওয়ার জন্য নারীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ভোট কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নারীরা ইভিএমের ব্যবহার সম্পর্কে অতোটা বুঝতে না পারায় তাদের ভোট দিতে দেরি হয়। এছাড়া অনেক বয়স্ক নারীর আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে দেরি হওয়ার আরো একটি কারণ।
সকাল সাড়ে ৮টায় শহরের আশ্রম রোডের আলহাজ মতিউর রহমান মহিলা ফাজেল মাদরাসায় গিয়ে দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতি কম। দুই-একজন করে ভোট দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন হাসিনা খাতুন নামে এক নারী। তিনি পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন বলে জানান। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে শংকরপুর গোলাম হোসেন প্যাটেল সরকারি প্রাথমিক কেন্দ্রেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। প্রিজাইডিং অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দুই-একজন করে ভোট দিতে আসছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটাররা ভোট দিতে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। পাশেই শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে কথা হয় পুলিশ পরিদর্শক সুমন ভক্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে তারা কড়া নজরদারি রাখছেন। এখন পর্যন্ত ভোটারদের কোনো অভিযোগ নেই।
নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের রূপদিয়া ওয়েলফেয়ার একাডেমিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ হাজার ৯ জন। জিরাট, শ্রীপদ্দি ও ঘোড়াগাছা গ্রামের ভোটাররা এখানে ভোট দিতে আসেন। এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার কৃষ্ণ প্রসাদ সাহা জানান, প্রথম দুই ঘণ্টায় ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর পরের দুই ঘণ্টা অর্থাৎ ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ কেন্দ্রে লাঠিভর দিয়ে পোতা বউ জেসমিনের সঙ্গে ভোট দিতে আসেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা নুরজাহান বেগম। কিন্তু ফিঙ্গার না মেলায় তিনি ভোট দিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। শ্রীপদ্দি গ্রামের আব্দুল করিম জানান, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। দুপুর ১২টার দিকে এ কেন্দ্রে পরিদর্শনে আসেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। তিনি আরো বলেন, কিছু কিছু স্থানে তার কর্মী-সমর্থকরা অভিযোগ করছেন। সেগুলো প্রশাসনকে অবহিত করেছি এবং সহযোগিতা পেয়েছি। কচুয়া ইউনিয়নের দেয়াপাড়া কেন্দ্রে দুপুর ১২টায় ভোট পড়ে ১৭ শতাংশ। এ কেন্দ্রের ভোটার ৩ হাজার ১১৩ জন। দেয়াপাড়া গ্রামের ভোটার সাহেব আলী জানান, কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভোট দিয়েছি। এ কেন্দ্রে মোটরসাইকেল এবং ঘোড়া প্রতীকের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তিনি জানান। প্রিজাইডিং অফিসার মুহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, অতুলনীয় পরিবেশ। কোনো প্রার্থী কিংবা পোলিং এজেন্টদের অভিযোগ নেই।
কৈখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুর ১টার দিকে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। ১ হাজার ৫৪৫ ভোটারের মধ্যে তখন পর্যন্ত সাড়ে ৩০০ মতো ভোট পড়ে। এ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন কবিতা রানী। তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রে আসতে কেউ বাধা দেয়নি। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। দুপুর ২টায় হামিদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই-একজনকে ভোট দিতে আসতে দেখা যায়। ৩ হাজার ৫৩৭ ভোটারের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভোট পড়ে ৮০৬টি। প্রিজাইডিং অফিসার ডিএম তবিবুর রহমান জানান, কেউ হেমারিং করেনি। কাউকে বুক চেতিয়ে আসতে দেখেননি। এককথায় কোনো উত্তাপ নেই। শান্ত পরিবেশ।
ফতেপুর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৩ হাজার ২১৪ জনের মধ্যে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট প্রদান করেন ৯২৬ জন। সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশে ভোট হচ্ছে বলে জানান এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ইকরামুল ইসলাম শাওন। শহরের নাজির শংকরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহিলা কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৯২৭ জন। দুপুর ২টা পর্যন্ত সেখানে ভোট দেন ৪৩৯ জন। প্রিজাইডিং অফিসার আশরাফুল ইসলাম জানান, এমন পরিবেশ আমি আগে দেখিনি। এখানকার পোলিং এজেন্টদের মধ্যে মিল লক্ষ্য করলাম। নাজির শংকরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৮৪৮ জন। দুপুর ২টা পর্যন্ত সেখানে ৬৫৬ জন ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার বাহারুল ইসলাম। যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) মহিলা ভোটার ১ হাজার ৫৫১ জন। ২টা পর্যন্ত সেখানে ভোট পড়ে ২২০টি। প্রিজাইডিং অফিসার অজিত কুমার সাহা জানান, ভোটার উপস্থিতি কম। তবে কোনো অশান্তি হয়নি।
বিকেল ৩টায় উপশহরের নিউ টাউন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার শহিদুল ইসলাম জানান, সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ চলছে। ২ হাজার ৯২৩ জন ভোটারের মধ্যে (সময় ৩টা) ৪৯৮ জন ভোট প্রদান করে। শেষ এক ঘণ্টা ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে বলে তিনি ধারণা করেন।
যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার ও পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বুধবার বেলা ১১টায় ভোটগ্রহণ চলাকালে শহরের এমএসটিপি বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এ দুজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, বুধবার সকাল ৮টা থেকে যশোরে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সদর উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ চলছে। মানুষ নির্বিঘেœ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত তারা কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাননি। সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নেই শান্তিপূর্ণ ভোট চলছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, ভোট কেন্দ্র ও আশেপাশের এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি বলে তিনি জানান।
