সাজেদ রহমান ।। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ৮ ডিসেম্বর সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত একটি রিপোর্ট করেন। যার শিরোনাম ছিল ‘যশোর ক্যান্টনমেন্টন পূর্বাঞ্চলের দ্বিতীয় শক্তিশালী পাক ঘাঁটি’। তিনি লেখেন-‘দুর্ভেদ্য যশোর ক্যান্টনমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ৯ নম্বর ডিভিশনের সদর দফতর। এই আমর্ড ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল এ এ আনসারি। মেজর জেনারেল আনসারির অধীনে আছে ২২ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলস, ২৫ নম্বর বালুচ, ১২ নম্বর পাঞ্জাব ও ২৭ নম্বর বালুচ রেজিমেন্টের কিছু অংশ। এই তিনটি রেজিমেন্টের পরিচালনা করছেন ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ হায়াত ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলসের পরিচালক হলেন লে. কর্নেল শামসুজ্জামান।
এখানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের এক স্কোয়াড্রনের বেশি কিছু ট্যাঙ্ক ও ২৫ পাউন্ডের ৭৫ মিলিমিটার আর্টিলারি আছে। তবে বয়সা সীমান্তের কাছে গরীবপুরে ট্যাঙ্ক লড়াইয়ে ভারতীয় ট্যাংক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানিদের ১৩টি ট্যাংক ইতোমধ্যে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর আগে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ওই ডিভিশনের তিনটি রেজিমেন্টের বহু সৈন্য হতাহত হলেও পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই ক্যান্টনমেন্টে অতিরিক্ত সৈন্য আমদানি করা হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট রক্ষা করার জন্য নাভারণ ও শার্শার (যশোর রোড বরাবর) মধ্যে একটি শক্তিশালি ব্যুহ রচনা করে। ভারতীয় সৈন্যদের অগ্রগতি রোধের জন্য তারা সেখানে তারা প্রায় দেড় মাইল লম্বা, ২৪ ফুট চওড়া, ৫ ফুট গভীর একটি খাল কেটেছে। এছাড়া ২০ থেকে ২৫টি বাংকার তৈরি করেছে। যশোর রোড ধরে যশোর শহরে যাবার পথে কপোতাক্ষ নদের উপর যে ব্রিজ আছে, তার পশ্চিম ও পূর্ব দিকে চারটি আর্টিলারি বসানো হয়েছে। যশোর শহরকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের আর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি হলো ঝিনাইদহ। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটি ব্রিগেডের অধিনায়ক হলেন ব্রিগেডিয়ার মুনির আহমেদ। এই ব্রিগেডে রয়েছে ট্যাংক ও আর্টিলারি। কিন্তু ভারতীয় সৈন্য বাহিনী যশোহর রোড বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ব্যুহকে বেশি ব্যতিব্যস্ত না করে পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানিদের ঘাঁটিগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। আর মুক্তি বাহিনী গ্রাম ঘুরে উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে যশোরকে ঘিরে রেখেছেন গত প্রায় ১০ দিন ধরে। ভারতীয় বাহিনীর অভিযান আরম্ভ হবার পর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টের প্রতিরোধ শক্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছিল। এখানে যশোরে পতন কিংবা আত্মসমপর্ণ হয়ে গেলে পদ্মার দক্ষিণ পারের তিনটি জেলা যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া পুরোপুরি ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে।
এটা উল্লেখযোগ্য যে, সাবেক পাকিস্তান সৈন্যদলের এক নম্বর ইস্টার্ণ বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছিল এবং গত ২৫ মার্চ ছিল রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই রেজিমেন্টের একজন বাঙালি অফিসার লে. কর্নেলকে ছুটি নিতে বলে। কিন্তু তিনি ছুটি নিতে অস্বীকার করলে তাকে হত্যা করা হয়। তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য বিদ্রোহ করে অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের ঘরের তালা ভেঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশের জন্মবন্ধু সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক। আমাদের যশোর রণাঙ্গনে তিনি কয়েকবার এসেছিলেন। সর্বশেষ এসেছিলেন যশোর মুক্ত হওয়ার পর মিত্র বাহিনীর সাথে। তাঁর লেখা সেই রিপোর্টটি ছিল এক ঐতিহাসিক রিপোর্ট। ৮ ডিসেম্বর তাঁর পত্রিকায় শিরোনাম ছিল ‘মুক্ত যশোরে বাঙালিদের নৃত্য’।
সিডনি শনবার্গ তিনি লেখেন-‘বাসের ছাদে বাঙালিরা নৃত্যপর। রাস্তায় তারা জোরগলায় স্বাধীনতার শ্লোগান দিচ্ছে। তাঁরা পরস্পর আলিঙ্গন করছে, উল্লাস ধ্বনি দিচ্ছে এবং বিদেশী দেখলে স্বতঃস্ফুর্ত আবেগ প্রকাশের জন্য এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরছে। বাঙালিদের জন্য আজ (৮ডিসেম্বর) হচ্ছে যশোরের মুক্তি দিবস-বিগত আট মাস যাবত পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ যে শহর ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে, বাঙালি বিদ্রোহ দমনের জন্য গত বসন্তে এই সব সৈন্য এখানে এসেছিল। ‘মুক্তিদাতা’ হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, যে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত সমর্থন করছে তাঁদের মতোই উল্লসিত এই সেনাবাহিনী। তবে অগ্রগতি থামিয়ে আনন্দউৎসব করার মতো সময় তাঁদের নেই। পশ্চাৎপসারণরত পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে চলেছে তাঁরা দক্ষিণ-পূর্বে খুলনার দিকে। যশোর থেকে চার মাইল দূরে খুলনা রোড ধরে এগোবার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে ভারতীয় বাহিনী। ট্র্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ির উপর বসে ভারতীয়রাও হাসছে, হাত নাড়ছে, ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্য সম্পর্কে সপ্তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক পদাতিক ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওরা ভীত-সন্ত্রাস্ত হয়ে পালাচ্ছে। ওদের হাতে ভালো অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভালো। কিন্তু মনের জোর একেবারেই নেই।’ প্রধানত পাঞ্জাবিদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের থেকে যত আলাদা, অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যও তেমনি। কেননা ভারতীয় বাহিনীতেও পাঞ্জাবিদের আধিক্য। তবে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও তাঁদের সমর্থক ভারতীয়দের মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ফারাক সাময়িকভাবে মুছে গেছে। সোৎসাহী বাঙালিরা ভারতীয় অগ্রাভিযান বহাল রাখতে সৈন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে নদীর ওপর পল্টুন সেতু স্থাপনায়, পশ্চাদপসরণকারী পাকিস্তানিরা স্থায়ী সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৩ মাইল ভেতরে যশোরের পথে একটি প্রধান সেতু কুশলী হাতে ধ্বংস করা হয়েছে। ইস্পাত ও কংক্রিটের সেতুর ছয়টি স্প্যানের পাঁচটিই মুখ থুবড়ে কপোতাক্ষ নদে আছে। পাশের রেল সেতুরও একই দশা। দুই রাত আগে যশোরের দিকে পিছু হটে যাওয়ার সময় পাকিস্তানিরা এই কাজ করেছে।
যশোর থেকে ৯ মাইল দূরে ঝিকরগাছায় এখন যে দৃশ্যের অবতারণা সেটাকে বালতি ব্রিগেড ও পিরামিড নির্মাণ কাজের সমন্বয় বলা যেতে পারে। বিধ্বস্ত সেতুর নিচে কাদাভর্তি নদীর পাড়ে লম্বা সারিতে দাঁড়ানো শত শত বাঙালি নতুন পল্টুন সেতু পাতার কাঠের গুড়ি এগিয়ে দিচ্ছে। তাদের মেশিনের মতো নিঁখুত কাজের পাশাপাশি আর্মি প্রকৌশলী দলের তামাটে সৈন্যরা হাঁটুজলে নেমে ফোলানো বিশাল পল্টুন ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং এর ওপর বসিয়ে দিচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের স্প্যান। চার ঘন্টার মধ্যে সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলো। সবাইকে মনে হচ্ছে অত্যন্ত খুশি-ভারতীয় সৈনিক, বাঙালি শ্রমিক, পথিপাশের্^র তদারককারীরাও। পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকে যাঁরা পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এখন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, সেই সব বন্ধু ও আত্মীয়ের হর্ষোৎফুল্ল পুনর্মিলনে মুখর হয়ে উঠেছে ঝিকরগাছা। কেউ কেউ ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, অন্যরা লুকিয়েছিল দেশের আরও ভেতরে। পুরনো বন্ধু পুরনো সেতুর অক্ষত একটি স্প্যানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাকালে বর্তমান সংবাদদাতা এক পুনর্মিলনী ঘটে। ইংরেজিতে শোনা গেল কন্ঠ, ‘‘আমাকে আপনার মনে আছে কি? নিশ্চয় মনে আছে। ইনি হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট আখতার-উজ-জামান, বাঙালি বিদ্রোহী, মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানির কমান্ডার। এক মাস আগে তাঁকে দেখি যশোরের দক্ষিণ-পশ্চিমে গেরিলাদের দখলকৃত একটি এলাকায়। তিনি তখন বলেছিলেন যে, যুদ্ধে জয়ী হতে মুক্তিবাহিনীর অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। আজ তিনি বললেন, সেটা হতো যদি আমরা একা লড়তাম। এখন তো আমরা বিরাট সাহায্য পাচ্ছি। হঠাৎ তিনি বললেন, এটা আমার জন্য একটা ঐতিহাসিক সেতু, জ্যোৎ¯œারাতে বান্ধবীকে নিয়ে আমি এখানে আসতাম নদীতে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবার জন্য। পুরনো স্মৃতি মনে করে তিনি হাসলেন।