সাজেদ রহমান : ‘খান ও রাজাকারদের হত্যা লীলার সাক্ষী’ শিরোনামে যুগান্তর পত্রিকায় ১৪ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছিল একটি রিপোর্ট। কলকাতায় ফিরে গিয়ে রিপোর্টটি লেখেন-‘যশোর শহর ও তার আশেপাশে গত মার্চ মাসের পর থেকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের হত্যালীলার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যশোর শহরের স্যাটেলাইট টাউনের পিছনে অবস্থিত বাবু নওয়াপাড়া গ্রাম। এখানে প্রতিটি গাছের ডালে শকুনের পাল। কুকুর কাক গতকালও গলিত শবদেহ থেকে আহার সন্ধানে রত।
গতকাল কলকাতার ও বিদেশী সাংবাদিকদের স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দারা মাটি খুড়ে মানুষের কংকাল বার করে দেখালেন। দুটি কুয়ার মধ্যে অগনিত মানুষের কংকাল। মাঠের মধ্যে এখানে সেখানে মরা মানুষে খুলি পড়ে।
দুটি গলিত শবদেহ নিয়ে গত কালও কুকুরের পাল টানাটানি করছে। গ্রামবাসীরা বললেন, প্রায় ১৫ দিন আগে এই দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে। যশোরে যেসব মানুষ ফিরে আসছেন তাঁদের পরিবারের অনেকেরই খবর নেই। রাজাকাররা তাদের হত্যা করেছে। বাবু নওয়াপাড়া মাঠে তাদের আত্বীয়রা সেই উম্মুক্ত গোরস্থান দেখতে দেখতে চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা করে অগণিত মরার খুলি মধ্যে নিজের আত্বীয়কে চিনে নেবার চেষ্টা করছেন।
আকারে একটু তারতম্য থাকলেও সব খুশিই দেখতে এক। মানুষের খুশি দেখেও মানুষ আপনজনকে –প্রিয়জনকে চিনতে পারেন না। আমাদের পথ দেখাচ্ছিলেন যে যুবকটি হাতে তার বন্দুক। সেই বন্দুকের নল দিয়ে তিনি একের পর এক খুলি তুলে তুলে দেখাচ্ছিলেন।
মরার খুলির ছবি তুলতে তুলতে নিজেকে পশু মনে হচ্ছিল। চাপা কান্না বুক ঠেলে উপরে উঠে গলায় ঠেকল। চোখের কোণেও দু’ফোটা জল বেরিয়ে এলো।
যশোর শহরের মাইল খানেক দূরে রাস্তার ধারে একটা মরার খুলি পড়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামালাম। আশে পাশের বাড়ি থেকে লোক এসে আমাকে ঘিরে ধরল। তারা জানাল, এই হতভাগ্যের নাম হিমাংশু কর(হমাংশু বিকাশ চন্দ্র)। আগে পুলিশ কনস্টেবল ছিল। রাস্তার উপর থেকে পরিবারের লোকজনকে পাচার করার সময় পাক সৈন্যের গুলিতে রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাটি ঘটেছিল এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। প্রতিবেশী পাক সৈন্যের ভয়ে মৃতদেহ সৎকার করতে সাহস হয়নি। শকুন-কুকুর-শিয়ালরাই সৎকার করেছে। খুলিটি আজও পড়ে আছে।
যশোরে যত মরা খুলি দেখেছি তার মধ্যে একটি মাত্র খুলির মালিকের পরিচয় কেবল জানা গেল।