সাজেদ রহমান: ‘যশোরের মানুষ এখন ঢাকার দিকে তাকিয়ে’ এই শিরোনামে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর যশোরের ঝিকরগাছার ডেটলাইনে রিপোর্ট পাঠিয়ে ছিলেন ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় সাংবাদিক মিহির বন্দোপাধ্যায়। যা তাঁর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল পরদিন ১১ ডিসেম্বর। তিনি লিখেছিলেন-‘মুক্ত যশোরের মানুষ এখন রাজধানী ঢাকার দিকে তাকিয়ে আছে। আর দিন গুণছে, কবে তারা পল্টন বা রমনার মাঠে আবার এক জনসমুদ্রে শামিল হয়ে গলা ফাটিয়ে বলবে ‘‘জয় বাংলা-জয় মুজিব”।
ইদ্রিস আর মিয়া সাহেব। একজন ছাত্র, একজন মুরব্বী। আর গফুর একজন রিকশাচালক। অন্যজন পাঠশালার শিক্ষক। এই চার বিচিত্র পেশার মানুষের সঙ্গে যশোর শহরের কাছে সড়কের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। মুজিবের কথা বলতে বলতে আবেগে ওদের সকলের গলা ধরে আসে। গুছিয়ে সব কথা শেষ করতে পারে না।
খানসেনাদের প্রতি দারুন ঘৃণা ওদের। ততোধিক ভালোবাসা মিত্রবাহিনীর ভারতীয় এবং বাংলাদেশের জওয়ানদের প্রতি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ মাস ধরে ওরা আশপাশের গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়েছে জীবন তুচ্ছ করে। এবার ওদের ঘরে ফেরার পালা।
ঘরের পানে চলেছে তারা সামান্য সম্বল টুকু মাথায় চাপিয়ে। সমানতালে কদম মিলিয়ে চলেছে জব্বার আর গফুরের স্ত্রী, মিয়া সাহেবের নাতি, ইদ্রিসের দিদি। পথে থেমে দু’মিনিট জিরিয়ে নেবার ফুরসৎ পর্যন্ত নেই তাদের। আজই যশোর শহরে ওরা ফিরতে চায়।
কারণ ওরা শুনেছে, বাংলাদেশের নেতারা ও মন্ত্রীরা শনিবার যশোরে আসবেন। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিলিত হবেন। এ সুযোগ ওরা কেউ হারাতে চান না।
আজ যশোর-ঢাকা, কাল নয় পরশু রমনা বা পল্টনের সেই জনসমুদ্র হয়তো আমার দেখার সৌভাগ্য হবে না। তাতে আমার দুঃখ নেই। ইদ্রিস আর তার দিদি, মিয়া সাহেব আর নাতি, জব্বার আর গফুর তাদের চোখ দিয়ে আমি আগাম সে দৃশ্য দেখে রাখলাম। এ সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
আরও একটি রিপোর্ট ছাপা হয় ১১ ডিসেম্বর। যার শিরোনাম ছিল ‘যশোরে বাংলাদেশ সরকারের নানা দপ্তর খোলা হচ্ছে’। যুগান্তর পত্রিকা লেখে-স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের পাক সৈন্যমুক্ত যশোরহর শহর পদার্পনের মধ্য দিয়ে আগামীকাল সরকারিভাবে বাংলাদেশ সরকারের শুভযাত্রার সূচনা হচ্ছে।
এক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি দফতরের যেমন স্বরাষ্ট্র, খাদ্য, কৃষি ইত্যাদির জরুরী শাখাগুলো যশোহরে অস্থায়ী ভাবে খোলা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে বিভাগগুলো যশোহর থেকে কাজ করবে।
এছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য রেল লাইন মেরামত করা হবে।’
-জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক