কল্যাণ ডেস্ক
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কাজ শুরুর আগে মতামত নিতে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের যে সংলাপ হবে, তা বিএনপিকে দিয়েই শুরু হচ্ছে। এই সংলাপে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী রূপরেখার ওপর বিএনপির পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে বৈঠকগুলো হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের বিষয়ে নানা মত দিয়েছিল। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিতে বলা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, “বৈঠকের জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আগামী শনিবার বেলা আড়াইটায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ আলোচনা হবে। “বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। তবে, প্রতিনিধি দলে কে কে থাকবে তালিকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। শীঘ্রই জানা যাবে।”
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ইতিমধ্যে দুই দফায় উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই এবারের আলোচনা হতে যাচ্ছে। বুধবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এই সংলাপের কথা জানান।
সেখানে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ দেশের আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ছয়টি কমিশনের কাজ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য দলের সঙ্গেও শনিবার আলোচনা করবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ।
সংস্কারের পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতদিনের মধ্যে হতে পারে—তা জানতে রাজনৈতিক মহলে সবারই আগ্রহ রয়েছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দিলেও দলটির নেতারা ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর সময় দেওয়া যেতে পারে বলে বিভিন্ন সময়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। পাশাপাশি জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি।
সেনাপ্রধান বলেন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের বিষয়ে কথা বললেও নির্বাচনের জন্য কোনও সময়সীমার ধারণা এখনও দেননি। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—শনিবারের সংলাপে বিএনপি কি নির্বাচনী রূপরেখার দাবি নিয়ে জোর দেবে কি না।
নির্বাচনী রূপরেখায় জোর
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত সংস্কারের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং নির্বাচনী রূপরেখা দেওয়ার বিষয়ে জোর দেবেন তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের বিষয়ে দলীয় অবস্থান ঠিক করতে ছয়টি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। এই কমিটিগুলো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার বিষয়ে দলের কর্মকৌশল ঠিক করবে।
মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হোন। গঠিত কমিটিগুলো হলো- সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসংক্রান্ত সংস্কার কমিটি।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত জানান। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির বৈঠকে থাকা স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলন, “রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বিএনপি তাদের মতামত ও সুপারিশ জাতির সামনে তুলে ধরবে। “মূলত সরকার গঠিত কমিটির সংস্কারবিষয়ক কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে দলের কৌশল তৈরি ও সে অনুসারে প্রাসঙ্গিক কাজ প্রণয়ন করতে কাজ করবে তারা।”
তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তা তারা কীভাবে সম্পন্ন করতে চাইছে অর্থাৎ সংস্কারের রোডম্যাপ কেন দেওয়া হচ্ছে না, সংস্কার কবে নাগাদ হব… এসব বিষয়েও আরও স্পষ্টীকরণ চান বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। বৈঠকে কয়েকজন নেতা মনে করেন, সংস্কারের বিষয়ে সরকার সময়ক্ষেপণ করছে।
“সেসব বিষয় তুলে ধরে সংস্কার ও বিশেষ করে নির্বাচনী রূপরেখা দ্রুত দেওয়ার ব্যাপারে জোর দেবেন তারা। কারণ, এটাই এখন জনগণের মূল চাওয়া।”
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলন, “আমরা আমাদের পর্যালোচনা কন্টিনিউ রেখেছি। পর্যালোচনা তুল ধরে এই মুহূর্তে যেভাবে দেশ পুরোপুরো গলতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল করা যায়, সেই বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার বিষয়গুলো নিয়েই আমরা আলাপ করব। “আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল যারা যাবেন, তারা সার্বিক দিকগুলো নিয়ে নিজেদের মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরবেন।”
কোন কমিটিতে কারা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় প্রস্তাবিত ছয়টি কমিটির মধ্যে সংবিধান পুনর্গঠন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। সদস্য আছেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক সুপন ও প্রফেসর ড. নাজমু জামান ভূঁইয়া ইমন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে। সদস্য হলেন-অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি মোহাম্মদ রইস উদ্দিন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বিচারক ইকতেদার হোসেন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির ও ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসিম।
পুলিশ বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম। সদস্যরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইউম, সাবেক ডিআইজি খোদা বক্স ও সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান।
প্রশাসন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে। সদস্যরা হলেন- সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে সাবেক বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি শরফুদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের নাম। সদস্যরা হলেন- ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ।
নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানকে। সদস্যরা হলেন-স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ।