নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতে পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি
বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে
দুর্ভোগের নাম ‘বেলা সাড়ে এগারোটা’
নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ এখন শুধু আলোচনা এবং পরিকল্পনার মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ। পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের নিরাপদ যাত্রা বা নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার যে পরিকল্পনা করেছিলো যশোরের ট্রাফিক বিভাগ, তার বাস্তবায়ন হয়নি। বরং প্রতিদিনই শহরের যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। এতে নাকাল অবস্থা জনগণের।
গত বছরের ১৬ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় যশোর ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) মো. মাহফুজুর রহমান যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগের বিস্তর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিলো, সু-শৃঙ্খল পার্কিং ব্যবস্থা করা, অতিরিক্ত যানবাহন শহরে প্রবেশ করতে না দেওয়া, লাইসেন্স ব্যতীত ইজিবাইক ও অবৈধ অটো রিকশার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, শহরের প্রতিটি প্রবেশ মুখে বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে অবৈধ যানবাহন প্রবেশ সীমিত করা। এই সিদ্ধান্তের সম্মতি জানিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকসহ আইনশৃঙ্খলা কমিটির অন্য সদস্যরাও। তবে এই সভার সাড়ে ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও ট্রাফিক বিভাগ এই পরিকল্পনার দৃশ্যমান করতে পারেনি। ফলে শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ আলোচনা এবং পরিকল্পনার টেবিলেই আটকে আছে।
শহরের ব্যস্ততম এলাকা দড়াটানা ও হাসপাতাল সড়ক। সকাল ৯টা গড়াতে না গড়াতেই তীব্র যানজটের দেখা মেলে এই এলাকায়। প্রায় প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজটের মধ্যে পরতে হয় সেখানে। শহরের শেখহাটি বাবলাতলা এলাকার বাসিন্দা ফয়জুর রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন তিনি। বাসা থেকে বের হয়ে প্রতিদিন সকালে দড়াটানা হয়ে তাকে যেতে হয় মুজিব সড়কে। ফয়জুর রহমান জানান, সকাল ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এই সড়কে প্রবেশ করলেই মুশকিল। অটো রিকশা আর ইজিবাইকের দখলে থাকে পুরো সড়ক। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও যানজট নিয়ন্ত্রণে তাদের নাকানিচুবানি অবস্থা হয়। এই সড়কে সন্ধ্যা থেকে যানজটের তীব্রতা আরও বাড়ে।
দড়াটানার মতো একই চিত্র শহরের মনিহার, আরএন রোড, চৌরাস্তা, এমএম আলী রোড, মুজিব সড়ক, নিউমার্কেট, ঘোপ নওয়াপাড়া রোড ও পালবাড়ির। শহরের যানজট নিরসনে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা এবং জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও ট্রাফিক বিভাগ দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। ফলে যানজট সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না। অভিযোগ আছে শহরে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ ইজিবাইক, অটো রিকশা প্রবেশ করলেও ট্রাফিক পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
দুর্ভোগের নাম ‘বেলা সাড়ে এগারোটা’ :
যশোর শহরের মহা এক দুর্ভোগের নাম ‘বেলা সাড়ে এগারোটা’। এই সময়টায় শহরের যান ও জনচলাচলের বেজে যায় পুরোপুরি বারোটা। এক ঘণ্টার যানজটে দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ফুটপাথ দখল থাকায় হাঁটা চলারও অবস্থা থাকে না। বেলা এগারোটার পর থেকে শহরের বেশিরভাগ স্কুল ছুটি শুরু হয়। এ সময়ে কয়েকটি সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ায় যাতায়াত স্থবির হয়ে পড়ে। অফিস-আদালত ঘেরা সিভিল কোর্ট মোড়ের যানজট হয়ে পড়ে একদম নিয়ন্ত্রণহীন। একবার জট বাঁধলে ছাড়াতে ঘণ্টার ওপর সময় লেগে যায়। এগারোটা থেকে ১২টা পর্যন্ত এখানকার তীব্র যানজট নিত্যদিনের সমস্যা। নাগরিক ভাবনা ভাবেন এমন অনেকের অভিমত, নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য মুজিব সড়কের সিভিল কোর্ট মোড়ের চারটি রাস্তার কোন কোনটি ‘ওয়ানওয়ে’ রাখতে হবে। বিশেষ করে স্কুল ছুটির সময় এই পথ দিয়ে বের হয়ে যানবাহন অন্য গন্তব্যে যেতে পারবে। কিন্তু ওই সময়ে সড়কটিতে যাত্রী নিয়ে ঢুকতে পারবে না। এমনটি করা গেলে এখানকার যানজট সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আইনজীবী শাহরিয়ার বাবু বলেন, সিভিল কোর্ট এলাকার যানজট নিত্যদিনের সমস্যা। তাদের মতো অন্যদেরও এর ভোগান্তি পোহাতে হয়। তিনি মনে করেন, সিভিল কোর্ট মোড়ের কাছাকাছি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর ছুটির সময় সড়কটি ‘ওয়ানওয়ে’ করা গেলে নিত্য এই দুর্ভোগ ঘোচানো সম্ভব হতে পারে। একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয় মোড়টির অদূরে পোস্ট অফিসের সামনে অক্ষর শিশু শিক্ষালয় ও কালেক্টরেট স্কুলের সামনের রাস্তায়। সিভিল কোর্টের মোড়ের যানজট একবার শুরু হলে মুজিব সড়কের সার্কিট হাউস পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। এখানকার যানজট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট মোড় ছাড়িয়ে যায়। একই দৃশ্য দেখা যায়, চিত্রা মোড় থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত। এক ঘণ্টার এই যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিকে কর্মরতরা গলদঘর্ম হয়ে যান। আদালত, পোস্ট অফিস, স্কুলসহ বিভিন্ন দফতরের অবস্থান থাকায় এমনিতেই সিভিল কোর্ট এলাকায় ভিড় লেগেই থাকে।
এ বিষয়ে পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব সড়কের শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু আমরা দেখি আমাদের ট্রাফিক পুলিশ তার উল্টোটা করে চলেছে। সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পরিবর্তে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে ট্রাফিক পুলিশ। যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে, শহরে অবৈধ ইজিবাইক, অটো রিকশায় ভরে গেছে। কিন্তু পুলিশ সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করছে না। যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনভাবেই সড়কে চলছে, যার কারণে যেমন যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যদি সঠিক দায়িত্ব পালন না করে তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কোনভাবেই সম্ভব না।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সভাপতি শাহিন ইকবাল বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর অন্যতম দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের। কিন্তু এই বিভাগটি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। পাশাপশি প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা, সেটিরও ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
শহরের যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগের পাশাপাশি পৌরসভারও দায়িত্ব রয়েছে। পৌর এলাকার মধ্যে যানজট নিরসনে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়া ও রিকশা স্ট্যান্ড নির্ধারণ, এবং অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে থাকে পৌর কর্তৃপক্ষ। যানজট নিরসনে পৌরসভার এই কার্যক্রমের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও বাকি কাজ অধরাই থেকে যায়।
জানতে চাইলে যশোর পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা জায়েদ হোসেন বলেন, যানজট নিরসনে পৌরসভার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং অবৈধ ইজিবাইক ও অটো রিকশার বিরুদ্ধে পৌরসভার অভিযান চলমান রয়েছে। পাশাপাফশ পৌর এলাকার কয়েকটি স্থানে রিকশা স্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য কাজ চলমান রয়েছে।
ট্রাফিক বিভাগের চাঁদাবাজির মহোৎসব
এদিকে একটি সূত্র ও ভুক্তভোগীরা অভিযোগে করেছে, ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) মো. মাহফুজুর রহমান ব্যস্ততম এলাকার যানজট নিরসনের পরিবর্তে ট্রাফিক ও সার্জেন্টদের দিয়ে চাঁদাবাজি করাচ্ছেন।
বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। এসব পয়েন্টে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বরত টিআই ও সার্জেন্টরা ফ্রিস্টাইলে চাঁদাবাজি করছেন। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনের কাগজপত্র দেখার নামে ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টদের দিয়ে গাড়ি আটকের পর মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। আর এ চাঁদাবাজি দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বেশি হচ্ছে। এজন্য দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের অনেক সার্জেন্ট সূর্য ডোবার অপেক্ষায় থাকেন। প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ মালামাল বহনকারী বিভিন্ন যানবাহন আটক করে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করছেন।
শহরের পালবাড়ি মোড় (যশোর-কুষ্টিয়া মহাসড়ক), চাঁচড়া মোড় (যশোর- বেনাপোল, মুড়লী মোড় (যশোর-খুলনা), ঝুমঝুমপুর ময়লাখানার সামনে (যশোর-ঢাকা মহাসড়ক) এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টরা যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার নামে চাঁদা আদায় করছেন। শুধু তাই নয়, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন নানা ব্রান্ডের গাড়ি কারণে-অকারণে থামিয়ে কাগজপত্র চেকসহ বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করছে। আবার অনেক গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক রাখায় যানজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করা নয়, সাধারণ মানুষকে হয়রানি আর টাকা আদায়ই তাদের মূল টার্গেট বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। রাস্তায় লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ফিটনেসবিহীন যাত্রীবাহী বাসসহ যানবাহনগুলো তাদের চোখে পড়ছে না। এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চালক ও মালিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা নিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) মো. মাহফুজুর রহমান উপস্থিতিতেই বিভিন্ন পয়েন্টে এসব চাঁদাবাজি প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে। আর দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য ও সার্জেন্টরা ওই চাঁদাবাজির নির্ধারিত ভাগের টাকা ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শকে পরিশোধ করতে হয় বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশেরই একাধিক সদস্য জানিয়েছেন।
এদিকে যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগের বর্তমান কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে যশোর ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) মো. মাহফুজুর রহমানের মুঠোফোনে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।